এতকাল জিনের ঢিবি নামেই পরিচিত ছিল স্থানটি। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আগৌলঝাড়ায় অবস্থিত এই স্থানকে ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত ছিল নানা উপকথাও। অতিলৌকিক নামের কারণেই এই স্থানে যেতে ভয় পেত সাধারণ মানুষ। এমনকি এখানে ভয় পেয়ে মানুষের মৃত্যুর কথাও শোনা যায়।
স্থানীয় রাজীব হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘বাবার মুখে শুনেছি, রাতারাতি একটি পুকুর খনন করেছিল একদল জিন। পরে পুকুর থেকে খনন করা মাটি তারা এখানে এনে ফেলেছিল। তাই ঝুঁড়িঝাড়া জিনের ঢিবি নামেই এ স্থানটি পরিচিতি পেয়েছে। এই ঢিবিতে আগে লোকজন আসতে ভয় পেত। এখানে নানা অসংগতিও চোখে পড়েছে অনেকের।’
তবে বিজ্ঞাননির্ভর আধুনিক যুগে এমন ধ্যানধারণার কোনো ভিত্তি নেই। তাই সব গুঞ্জন দূরে সরিয়ে ঢিবিটি খনন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। আর তাতেই মিলল এক অত্যাশ্চর্য ফল!
যুগ যুগ ধরে জিনের ঢিবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই ঢিবি খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেলেন এক বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন। এর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের ওই এলাকাটিতে হাজার বছরের পুরোনো এক মানব সভ্যতার অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা ধারণা করছেন, সুন্দরবনসংলগ্ন ওই এলাকাটিতে দেড় হাজার বছর আগে এক জনবসতি ছিল। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে ওই জনবসতির জীবনযাত্রার নানা চিহ্ন।
জানা যায়, শুরুর দিকে ঢিবিটি অনেক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত থাকলেও পরে চারপাশ থেকে অনেক জায়গা মানুষের দখলে চলে যায়।
অবশিষ্ট ঢিবিতে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর খননকাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ছয় সদস্যের একটি ইউনিট। অর্ধ একর জায়গাজুড়ে টানা তিন মাস খননের পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে মধ্যযুগীয় ইটের তৈরি কাঠামোর স্থাপত্যশৈলী।
পরে ঢিবির নিচে পাওয়া ইট নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর ধারণা পাওয়া যায়, স্থাপনাটি সপ্তম শতক কিংবা তারও আগে নির্মিত একটি বৌদ্ধ মন্দির। ক্রুশাকৃতির মন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে ৯৯ দশমিক ৪০ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৯৫ দশমিক ৪০ মিটার। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহসহ ছোট-বড় প্রায় ৩৩টি কক্ষ, প্রদক্ষিণ পথ ও পশ্চিম দিকে মন্দিরের প্রবেশপথ আবিষ্কৃত হয়েছে।
খননকাজের তত্ত্বাবধায়ক আফরোজা খান মিতা জানান, সদ্য আবিষ্কৃত মন্দিরটির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ভরতভায়নার সাদৃশ্য আছে। এ ছাড়া এখানে পাওয়া মৃৎ পাথর ও অন্যান্য বস্তু থেকে অনুমান করা হচ্ছে, স্থাপনাটি আদি মধ্যযুগীয়। মন্দির স্থাপিত হওয়ার এখানে মানববসতি ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রত্নস্থানটির বয়স এক থেকে দেড় হাজার বছর হতে পারে।
মিতা বলেন, ‘প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। স্থানটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ন কবির জানান, স্থানটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে। দেখাশোনার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মী রয়েছেন। তবে আরও বেশি পর্যটনবান্ধব করতে বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।