উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। জেলাটি কৃষিতে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যে। জেলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনা, প্রত্ন নিদর্শন। কিছু নিদর্শন সরকার সংরক্ষণ করলেও এখনও অরক্ষিত বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপনা। কালের বিবর্তনে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
জেলাটিতে এখনও এমন অনেক প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, যা অনেকের অজানা। তেমনই এক নিদর্শন পাশাপাশি সাড়ে তিন শতাধিক পুকুর। স্থানীয়রা অবশ্য বলছেন, সেখানে একসঙ্গে রয়েছে ৩৬৫ পুকুর। যেগুলো অনেক পুরোনো।
অবস্থান
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪৯ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাট। উপজেলা সদর থেকে আরও ১৯ কিলোমিটার দূরে ইসবপুর ইউনিয়ন। সেই ইউনিয়নের চান্দিরা গ্রামের শেষ প্রান্তে অবস্থিত পাশাপাশি বিশাল ৩৬৫টি পুকুর। নওগাঁ জেলায় একসঙ্গে এতগুলো পুকুর আর কোথায় নেই।
প্রচলিত মিথ
স্থানীয়রা দীর্ঘদিন থেকেই লোকমুখে শুনে আসছেন, পুকুরগুলো খনন করা হয়েছিল পাল আমলে। সেটা অষ্টম শতাব্দীর দিকে। সে সময় কোনো এক রাজার শাসনকালে রানি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার রোগ সারাতে রজ্যের বৈদ্য, হেকিমদের ডেকে পাঠানো হয়, অনেকেই অনেক ব্যবস্থাপত্র দেন, তবে রোগ সারে না রানির। পরে এক হেকিম রাজাকে বলেন, ৩৬৫ পুকুর খনন করতে হবে। সেসব পুকুরে প্রতিদিন রানি গোসল করবেন। এভাবে এক বছর গোসল করলে রোগ সেরে যাবে। হেকিমের কথামতো রাজা তখন খনন করেন সেই ৩৬৫ পুকুর।
যা বলছেন গবেষকরা
স্থানীয়দের মুখে মুখে সেই পুকুরগুলো নিয়ে এমন গল্প ফিরলেও এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউ দিতে পারেননি।
ধামইরহাট এম এম ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও গবেষক শহিদুল ইসলাম পুকুর খননের ইতিহাস নিয়ে স্থানীয়দের মুখে ফেরা সে কথাটিকেই সত্য বলে জানান। অবশ্য তিনিও অষ্টাদশ শতাব্দীর সময় পাল শাসনামলে পুকুরগুলো খনন করা হয়েছে বলে দাবি করেন।
প্রত্যন্ত এমন গ্রামে একসঙ্গে এতগুলো পুকুর ঠিক কবে খনন করা হয়েছে জানতে চেয়ে একাধিক গবেষকের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. চিত্তরঞ্জন মিশ্রর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নে থাকা পুকুরগুলো সম্পর্কে জানেন বলে নিউজবাংলাকে জানান। তবে পুকুরগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনিও।
অবশ্য তিনি আরও দুই গবেষকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন, যারা সেগুলো নিয়ে জানেন বলেও জানান অধ্যাপক মিশ্র।
পরে কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের গবেষক অধ্যাপক ড. কাজী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তার কাছে নিউজবাংলা ইসবপুরের ৩৬৫ পুকুরের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রানির অসুখ সারাতে রাজা ৩৬৫ পুকুর খনন করেন, সেগুলোতে প্রতিদিন এক পুকুরে রানি এক দিন করে গোসল করেন যে কথা প্রচলিত আছে, এর সবই মিথ। এগুলো সত্য নয়।’
তিনি বলেন,‘ নওগাঁ প্রাচীন আমল থেকে খুবই সমৃদ্ধ একটি স্থান। এই অঞ্চলের যে কয়েকটি মহাবিহার, তার দুটিই নওগাঁয় অবস্থিত। ধামইরহাটের ইসবপুরে যে পুকুরগুলোর কথা বলা হয়, এগুলো সব এক আমলের নয়। কিছু আছে পাল শাসনামলের, কিছু আছে মুসলিম বা মোগলদের শাসনামলে।’
তিনি জানান, ইসবপুরে সাধারণ দুই আকৃতির পুকুর আছে, কিছু পূর্ব-পশ্চিম লম্বা, আর কিছু উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। যেসব পুকুর উত্তর-দক্ষিণমুখী সেগুলো মূলত পাল আমলে খনন করা হয়েছিল। আর পূর্ব-পশ্চিমমুখী পুকুরগুলো মুসলিম শাসনামলে অনেক পরে খনন করা।
অবশ্য এখন কিছু পুকুর চার কোনাকৃতির দেখা যায়, এগুলো এমন ছিল না। দীর্ঘদিন থেকে নানাভাবে এগুলো এমন আকৃতি নিয়েছে বলে জানান তিনি।
গবেষক মোস্তাফিজুর জানান, বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় পাল আমলেও পানির তীব্র সংকট ছিল এই এলাকায়। তাই রাজা বা শাসকরা সে সময় বড় বড় পুকুর খনন করতেন। ইসবপুরের যেসব পুকুর সেগুলো খনন করা হয়েছিল মূলত জনকল্যাণে। পানির সংকট যেন না হয়, সে জন্য রাজারা এসব পুকুর খনন করতেন তাদের নিবাসের আশপাশে। দূর-দূরান্ত থেকে এসব পুকুরে আসতেন তখনকার প্রজারা। তারা খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতেন এসব থেকে।
এ ছাড়া এসব পুকুরের আশপাশে ছিল মন্ত্রী, রাজ্যের বিভিন্ন কর্মচারীদের আবাস। তারা নির্দিষ্ট কিছু পুকুরে প্রাতাহ্যিক কাজ ও কিছু পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতেন। এসবই সেই ৩৬৫ পুকুর খননের সঠিক ইতিহাস, যা সময়ের ব্যবধানে রানির অসুখের গল্প আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের পরিচালক ড. আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক গবেষকই নওগাঁর প্রত্ন নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তবে ধামইরহাটের ইসবপুরের যে ৩৬৫ পুকুরের কথা বলা হয়, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বা নিবন্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে বের করা কোনো ম্যাগাজিনে উঠে আসেনি।’
এই অধ্যাপকও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য
স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোরশেদুল আলম বলেন, ‘একই সঙ্গে ৩৬৫ পুকুর দেশের আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই। রানির অসুখ সারতেই এসব পুকুর পাল আমলে খনন করা বলে আমরা জেনে এসেছি। এখন পুকুরগুলোর চারপাশে বনায়ন কার্যক্রম করা হয়েছে বন বিভাগের পক্ষ থেকে। সরকার যদি একটু উদ্যোগ নেয়, তবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে এই স্থানটিতে।’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ আসাদুর রহমান বলেন, ‘এমন স্থাপনা দেশের অন্য স্থানেও আছে বলে মনে হয় না। এ স্থান তেমনভাবে পরিচিতি পায়নি। তাই সরকারের উচিত স্থানটিকে পর্যটনমুখী করার উদ্যোগ নেয়া।’
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নওগাঁ জেলা যেমন কৃষিতে সমৃদ্ধ, ঠিক তেমনি ইতিহাসে বিজড়িত। অনেক প্রাচীন দর্শনীয় স্থান আছে এ জেলায়। আবার অনেক স্থান পরিচিতি ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তপ্রায়। ধামইরহাটের চান্দিরা গ্রামের ৩৬৫টি পুকুরও কিন্তু ইতিহাসের স্মৃতি বহন করে।
‘পাল বংশের রাজ্য শাসনের শেষ দিকে পুকুরটি খনন করা হয়েছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়। এখনও পুকুরগুলো অক্ষত রয়েছে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেইনি স্থানটিকে সবার মধ্যে তুলে ধরার। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সবার মধ্যে তুলে ধরতে ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা গেলে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, অন্যদিকে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে দাবি করেন তিনি।
বনায়ন
ধামইরহাট বন বিট কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, চান্দিরা গ্রামের ৩৬৫টি পুকুর অনেক প্রাচীন। পুকুরগুলো সরকারিভাবে লিজ দেয়া আছে। তবে পাড়ে বনায়ন করেছে বন বিভাগ। সে জন্য পুকুরপাড়ের চারপাশে বিভিন্ন জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। জায়গাগুলো অনেক সুন্দর, একসঙ্গে এতগুলো পুকুর আর পুকুরপাড়ে নানা জাতের গাছের ছাঁয়া যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে। একটু উদ্যোগ নিলে স্থানটি বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র হতে পারে।
পর্যটনে জোর স্থানীয় প্রশাসনের
নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গণপতি রায় বলেন, ‘একই সঙ্গে ৩৬৫টি পুকুর সত্যিই দারুণ বিষয়। এ এলাকাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে চান্দিরা গ্রামের ওই পুকুরগুলোতে যাতে খুব সহজেই যাওয়া যায়, সে জন্য রাস্তা নির্মাণেরও উদ্যোগও গ্রহণ করা হবে।’