যতদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। রহিমা খাতুনের ঘরটি দূর থেকে দেখলে মনে হয় পানিতে ভেসে আছে। ঘরের ভেতরও পানি। এর মধ্যেই স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকছেন, যাননি আশ্রয়কেন্দ্রে।
রহিমার বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ে। এই পুরো ইউনিয়নই এখন পানির ওপর ভাসছে। প্রতিটি ঘরেই পানি। বড় বড় ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছে মাটির ঘরবাড়ি।
এমন অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্র কেন গেলেন না রহিমা?
তিনি বলেন, ‘ঘর ছেড়ে গেলে তো গরিবের যে সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, তাও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পানি। চোরেরা লুটে নেবে। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রেখেছি ঘরটা।’
কখনও পানির ওপর, আবার কখনও নৌকায় বা চৌকিতে উঠে দিন কাটে রহিমার। তবে রাতে সাপের ভয়ে তার ঘুম আসে না।
রহিমা বলেন, ‘দিনেই অনেক সাপ ঘরের আশপাশ দিতে ভেসে যেতে দেখি। একদিন ঘরেও ঢুকে পড়েছিল একটা বিষাক্ত সাপ। তাই রাত হলে আর সাপের ভয়ে ঘুমাতে পারি না। রাতে তো কিছু দেখা যায় না। তাই ভয়ে থাকি। ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি।’
কাঠইর ইউনিয়নের বাসভাসিদের এখন ভয় ঢেউয়ের তোড়ে ঘর ভাঙার আর সাপের। সঙ্গে যোগ হয়েছে খাবারের সংকট ও রোগবালাইয়ের শঙ্কা।
মাঝে মাঝে নৌকায় করে কিছু লোক আসেন এখানে। খাবার, পানি ও ওষুধ দিয়ে যান তারা। এসবের ওপরেই নির্ভর করে দিন কাটছে সুনামগঞ্জ শহর লাগোয়া এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।
রহিমা খাতুনের ঘর থেকে বেরিয়ে নৌকায় করে কিছুদূর এগোতেই দেখা মেলে আরেক বৃদ্ধের। পানিতে প্রায় ভেসে আসছেন, যেন কচুরিপানা।
বৃদ্ধের নাম আসকর আলী। কাছে যেতেই বললেন, ‘১৫ দিন ধরে ঘরসহ পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। পানি কিছুতেই কমছে না। ঘরে বসে থেকে তো আর চলছে না। তাই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছি। দেখি কোথাও কিছু পাই কি না।’
এই ইউনিয়নের কলাইয়া গ্রামের মো. শহিদুলও রাতে ঘুমাতে পারেন না। তার ঘরেও পানি।
হাওর অঞ্চলে এই বড় বড় ঢেউকে আফাল বলে।
শহিদুল বলেন, ‘আফালের কারণে ঘরের বেড়া ভেঙে পড়ছে। একেকটা আফাল আসে আর মনে হয় এই বুঝি পুরো ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। সারা রাত জেগে আল্লাহ আল্লাহ করি।’
একই অবস্থা পাশের মোহনপুর ইউনিয়নেরও। সেখানকার দেওয়াননগর গ্রামের আসলাম মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুদিন আগে আমার মেয়ে খুব অসুস্থ হয়েছিল। কিন্তু তাকে কোনো ডাক্তার দেখাতে পারিনি। ওষুধ কিনে দিতে পারিনি।
‘পানির কারণে এই এলাকায় কোনো ফার্মেসি ও দোকানপাট খোলা নেই। কারও অসুখ হলেও ঘরে বসে মরা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
কাঠইর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য জ্যোৎস্না বেগমের ঘরেও পানি।
তিনি বলেন, ‘এখন আর কী পানি দেখছেন। আর পাঁচ-ছয় দিন আগে এলে দেখতেন অবস্থা। অনেক মানুষ ঘরের চালে উঠে তীরে ধরে বসেছিল। পুরো ঘরই তলিয়ে গিয়েছিল পানিতে। এখন আবার পানি বাড়ছে।’
শহর ছাড়া গোটা সুনামগঞ্জেরই চিত্র এমন। শহর থেকে পানি দুদিন ধরে নামছে।
গত ১৫ জুন থেকেই পানিবন্দি পুরো সুনামগঞ্জ এবং সিলেট। সরকারি হিসাবেই এই দুই জেলায় অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি এখনও। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি।
সুনামগঞ্জ শহরে ঢুকতেই দেখা যায়, বিভিন্ন সড়কের পাশে লেপ, তোশক, জাজিম স্তূপ করে ফেলে রাখা। চৌকিসহ আসবাবপত্রও ফেলে রাখা কয়েক জায়গায়।
শহরের নতুনপাড়া এলাকার সুজক নন্দী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় ১০ দিন ঘরের ভেতর পানি ছিল। পানি এত দ্রুত বেড়েছে যে কোনো আসবাবপত্র সরানো যায়নি। পানি নামার পর আজ ঘরে এসে দেখি লেপ-তোশক পচে গন্ধ হয়ে গেছে। তাই এগুলো ফেলে দিচ্ছি। আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে অনেক।’
স্থানীয় সরকার বিভাগ সুনামগঞ্জের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেনের সরকারি বাসাও তলিয়েছে বন্যায়।
জাকির সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীরও দায়িত্বে আছেন।
ঘরে পানির চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম তলা পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। পানিহীন কোনো একতলা বাসা ছিল না এখানে। প্রথম দুই-তিন দিন তো একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল সবাই। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আমরাই কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না।’
পানি কমছে সিলেটে
গত দুদিন বাড়ার পর শুক্রবার থেকে আবার কমতে শুরু করেছে সুরমা নদীর পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সুরমার পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৪ সেন্টিমটার কমেছে। তবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে কুশিয়ারা নদীর পানি।
তবে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে শুক্রবারও। এই বৃষ্টিতে অবশ্য পানি বাড়ার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা।