লক্ষ্মীপুরে মেঘনার পানি বাড়ায় কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ১৫টি এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙন।
তিন মাস বন্ধ থাকার পর বাঁধের কাজ শুরু হলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে প্রায় ৩ হাজার ১ শ কোটি টাকার বাঁধ কোনো কাজে আসছে না।
দ্রুত বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য মানববন্ধনও করেছেন নদী পারের মানুষ।
পাউবো জানায়, গত বছরের জুন মাসে ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা প্রকল্প বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর ৯৯ প্যাকেজে ভাগ করে আগস্টে প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
প্রথম পর্যায়ে ২৪ প্যাকেজে ১৫ জন ঠিকাদার টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পায়। গত ৯ জানুয়ারি কমলনগরের সাহেবের হাট এলাকায় জিও ব্যাগ ডাম্পিয়ের মাধ্যমে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের উদ্বোধন করেন।
এরপর ১৩ জন ঠিকাদার কাজ শুরু করলেও বালু সংকটের কথা বলে তারা কাজ বন্ধ করে দেয়। জুনের শুরুতে আবার সেই কাজ শুরু হয়।
কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীহাট এলাকার এএইচএম ফারুক বলেন, ‘এক বছর আগেই প্রকল্প দেয় সরকার কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও কোনো কাজই হচ্ছে না। এখন বর্ষা। এই বর্ষায় যেভাবে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে এটা অব্যাহত থাকলে বহু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা বিলীন হয়ে যাবে। গত ১০ দিনে ভাঙনের কারণে দুই শতাধিক পরিবার অন্য জায়গায় গিয়ে থাকছেন।’
চর লরেন্সের নাছিরগঞ্জ বাজারের পাশের সিরাজুল ইসলাম জানান, গত ১০ বছরে অন্তত ১৫ বার তিনি ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এখন নদী তার ঘর থেকে একশ গজ দূরে। যে কোনো মুহূর্তে নদীতে তলিয়ে যাবে। এরপর তার আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না।
রামগতির চর আলেকজান্ডার এলাকার জাফর আহমদ গনি বলেন, ‘যেভাবে বাঁধের কাজ হওয়ার কথা তার বিন্দু পরিমাণও হচ্ছে না। প্রকল্প দেয়ার পর অনেক স্বপ্ন দেখেছি। আর ভাঙনের মুখে পড়তে হবে না বলে আশায় ছিলাম।
‘কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং নতুন করে রামগতির আসলপাড়া, বাংলা বাজার, জনতা বাজার, চর আবদুল্লাহ, বড়খেরী এবং কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট, পাটওয়ারীহাট, চরকালকিনি, চরফলকন, লূধুয়াসহ অন্তত ১৫টি এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।’
চর লরেন্সের হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রতিদিনই নতুন করে বসতভিটা ভাঙছে। অনেকেই ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। তিন যুগ ধরে টেকসই বাঁধ না থাকায় ৪৪ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। পাউবো বিভিন্ন সময় ভাঙন ঠেকাতে প্রকল্প নিলেও তা কোনো কাজে আসেনি।’
রামগতি উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মেজবাহ উদ্দিন হেলালের অভিযোগ, তিন মাস বন্ধ থাকার পর কাজ শুরু হলেও তা থেমে থেমে চলছে। পাউবোর গাফিলতির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো কাজ করছে না।
দ্রুত বাঁধ তৈরি না হলে কয়েক মাসের মধ্যে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে।
এসব বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টেকের কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রথমে যে কয়জন ঠিকাদার বাঁধের কাজ পায় তাদের মধ্যে ন্যাশনাল টেকও একটা। তবে বালু সংকটের কারণে বাঁধের কাজ ব্যাহত হয়।
‘এখন বর্ষা ও নদীতে স্রোতের কারণে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। তবুও কাজ চলছে। কাজে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা হবে।’
লক্ষ্মীপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, বালু সংকট কেটে যাওয়ায় পুরোদমে কাজ চলছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, ‘বর্তমান সরকার লক্ষ্মীপুরে ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ১ শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর আগে কোনো সরকার নদীভাঙন প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
‘নির্ধারিত মেয়াদেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। সরকারের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুফল ভোগ করবে এ অঞ্চলের লাখো মানুষ। কাজে কোনো গাফিলতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর ভাঙনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে চর সোনারামপুরের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষ। গত কয়েকদিনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে দুটি ঘরের একাংশ, দেবে গেছে শ্মশানের মাটি।
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের রিভারক্রসিং টাওয়ারের নিচের অংশ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মেঘনা নদীর চরের উজানে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদীর তীর দখল ও বর্ষায় তীব্র স্রোতের কারণে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই বর্ষার শুরু ও শেষের দিকে টাওয়ার এলাকা ও শ্মশান ঘাট এলাকায় ভাঙন হয়।
চরের বাসিন্দা ইব্রাহিম মোল্লা বলেন, ‘কয়েক বছর আগে চরের উজানে মেঘনা নদীতে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করার পর থেকে প্রতি বছরই বর্ষায় ভাঙন হয়। আমরা চরের পাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।’
আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরবিন্দ বিশ্বাস জানান, চরের ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।
পাউবোর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘যেসব এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে সেখানে ৭ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হবে। এরই মধ্যে ৪ হাজার ব্যাগ ফেলা হয়েছে।’
ভাঙনকবলিত এলাকা বুধবার পরিদর্শন করেছেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ডিজাইন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী।
তিনি বলেন, ‘টাওয়ারের নিরাপত্তার জন্য ২০১৯ সালে সেসব জিও ব্যাগ ও সিমেন্টের ব্লক ফেলা হয়েছিল সেগুলা কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে ও স্থানচ্যুতি হয়েছে। টাওয়ার এলাকায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পানি আছে।
‘তা ছাড়া টাওয়ারের পশ্চিম পাশে নতুন করে প্রবল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এতে ওই অংশের মাটি সরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
এ বিষয়ে পিজিসিবির স্থানীয় কর্মকর্তা উপসহকারী প্রকৌশলী মো. হানিফ বলেন, ‘টাওয়ার এলাকা নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে। লোকজনকে টাওয়ারের কাছাকাছি না যেতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিষয়টি নজরদারি করার জন্য নৌ-পুলিশকে অনুরোধ করা হয়েছে।’
একই কথা জানান ভৈরব নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘টাওয়ারের আশপাশে যেন কেউ ঘেঁষতে না পারে সে জন্য নৌ-পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।’