রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ছিল দেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সামর্থ্যের সবচেয়ে বড় প্রদর্শন। এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ দেশি-বিদেশি নাগরিক। ভয়াবহ এই হামলার পর ছয় বছর কেটে গেছে।
হামলার পর দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়াশি অভিযানে নতুন কোনো হামলা বা নাশকতা চালানোর সক্ষমতা হারিয়েছে জঙ্গিরা। এখন জঙ্গি কার্যক্রম অনেকটা অনলাইনভিত্তিক হয়ে পড়েছে। সেটিও গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে আছে। জঙ্গি সংগঠনগুলোকে এখন একটি পর্যুদস্ত শক্তি বলে মনে করেন নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টরা।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টা ৪২ মিনিটে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ জঙ্গি আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালায়। সেখানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। বেকারিতে আসা দেশি-বিদেশি অতিথিদের বেছে বেছে হত্যা করতে শুরু করে, স্টাফদের রাতভর জিম্মি করে রাখে।
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোদের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাব যৌথ অভিযান চালায় ওই ভবনে। অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’।
কমান্ডো অভিযানে মারা যায় পাঁচ জঙ্গি। তারা হলো রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। উদ্ধার করা হয় হোলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি অবস্থায় থাকা অতিথি ও স্টাফদের।
জঙ্গিদের হামলায় পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম, ওসি সালাউদ্দিনসহ ২২ জন নিহত হন। বাকি নিহতদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় এবং একজন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। বাকি দুজন বাংলাদেশি নাগরিক। তারা হলেন ইশরাত আকন্দ ও ফারাজ আইয়াজ হোসেন।
হোলি আর্টিজানে হামলার পর দেশব্যাপী সাড়াশি অভিযানে নামে সিটিটিসি, র্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। এসব অভিযানে একে একে শীর্ষ জঙ্গিদের একটা বড় অংশ মারা যায়। বাকিরা ধরা পড়ে।
সিটিটিসি জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সারা দেশে ২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালিয়েছে সংস্থাটি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত এসব অভিযানে ৬৩ জঙ্গি নিহত হয়।
র্যাবের দেয়া তথ্যমতে, তারা চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত ৭৭৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে আস্তানা ছিল ৫৪টি। এসব অভিযানে বিভিন্ন সংগঠনের ১ হাজার ৬৭৮ জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। আত্মসমর্পণ করেছে ১৬ জন।
পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১০৮টি অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৭৩ জঙ্গি।
হামলার ছয় বছর পর বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসে অন্যতম বড় একটি ঘটনা হোলি আর্টিজান। মামলার তদন্তভার সিটিটিসির ওপর বর্তায়। সংস্থাটি মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এই মামলার রায় হয়েছে।
‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছিল, তাদের একজন বাদে সবাইকে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিয়েছে আদালত। সিটিটিসি জঙ্গিদের প্রায় সকল আস্তানা খুঁজে বের করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়েছে। হোলি আর্টিজানের পরে যেসব অভিযান হয়েছে, তার প্রায় সবই হয়েছে জঙ্গিদের আস্তানায়।’
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এরপর আমরা জঙ্গি সংগঠনগুলোর আর কোনো অপারেশন লক্ষ করিনি। বিচ্ছিন্ন যা দুয়েকটা ছিল, সেগুলো যৎসামান্য। পরবর্তীতে সেগুলোও আমরা উদঘাটন করেছি। এর পেছনে যারা ছিল, সকলকেই সিটিটিসি গ্রেপ্তার করেছে।
‘সর্বশেষ ২০২১ সালে মে মাসে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ বক্সের পাশে যে একটা আইইডি (হাতে বানানো বিস্ফোরক) তারা রেখে এসেছিল, সেটার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করেছি। এমনকি তারা যে আস্তানায় বসে আইইডি প্রস্তুত করেছিল, এর সঙ্গে যারা যারা জড়িত, সবাইকে আমরা অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছি।’
জঙ্গিরা হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘গত দুই বছরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কোনো অপারেশন আপনারা দেখেন নাই। আমরা বলব, জঙ্গিদের সে রকম কিছু করার সক্ষমতা নাই। কোনো ধরনের সক্ষমতা নাই।
‘সিটিটিসির আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের কার্যক্রমের কারণে জঙ্গিদের তৎপরতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কোনোভাবেই তাদের পুনরায় সঙ্ঘটিত হতে দেব না। এটা আমাদের অঙ্গীকার। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর যে জিরো টলারেন্স, সেটাকে আমরা প্রিন্সিপাল ধরে কাজ করছি।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযান ও দেশের মানুষের সহযোগিতায় জঙ্গিরা দেশে স্থায়ী হতে পারেনি। তারা পরাজিত শক্তিতে পরিণত হয়েছে বলে জানান।’
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হোলি আর্টিজান-পরবর্তী জঙ্গিবাদ অনেকটা অনলাইনভিত্তিক হয়ে পড়ছিল। বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে কখনই প্রশ্রয় দেয়নি। বিভিন্ন সময়ে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানে তাদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছি।
‘বাংলাদেশে আজ জঙ্গিবাদ পরাজিত শক্তিতে রূপ নিয়েছে। আমরা এটা শুধুমাত্র অভিযান করে পারিনি, এর মূল শক্তি জনগণ। দেশের জনগণ কখনই তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। যে কারণে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক এ দেশে স্থায়িত্ব পায়নি।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘হোলি আর্টিজানের পর র্যাব দেশব্যাপী সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছে। প্রায় ১৬০০ জঙ্গি গ্রেপ্তার করেছি। এদের মধ্যে প্রায় ৯০০ জেএমবি। শুধু অভিযান করেই থেমে থেকেছি এমন নয়, সাইবার স্পেসে নিয়মিত মনিটরিং করে, জঙ্গিবাদে যারা জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে শনাক্ত করেছি। তাদের নিয়ে এসে কাউন্সিলিং করে ডির্যাডিক্যালাইজ করেছি। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি।
‘যাদের জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, আমরা তাদেরকেই গ্রেপ্তার করি না। কেউ কট্টরভাবে জড়িয়ে না গেলে তাদের ডির্যাডিক্যালাইজ করি, পরিবারের কাছে দেই এবং নজরদারির মধ্যে রাখি।
‘আমাদের এই ধরনের কার্যক্রম চলমান আছে। তবে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। নিয়মিত সাইবার মনিটরিং চলছে, আমাদের হিউম্যান ইন্টেলিজেন্ট চলমান রয়েছে। একসময়ে যারা জঙ্গিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের কেউ কেউ বহু বছর ধরে লুকিয়ে ছিল। তাদের আমরা খুঁজে বের করে আইনের হাতে তুলে দিচ্ছি। লুকিয়ে থেকে সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ করে পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে সঙ্ঘটিত হতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আভিযানিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
সাতজনের ফাঁসির রায়, একজনকে অব্যাহতি
হোটি আর্টিজান হামলার দুই বছর পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর।
তৎকালীন সিটিটিসির প্রধান (বর্তমান এসবি প্রধান) মনিরুল ইসলাম সেদিন বলেন, ‘২১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছি। এর মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। নিহতদের ভূমিকা উল্লেখ করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাকি আটজনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে।’
এ মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করে। রায়ে সাত জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত।
এরা হলো জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন র্যাশ, মো. হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মো. আব্দুল সবুর খান, শরিফুল ইসলাম খালেক ও মামুনুর রশীদ রিপন। প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান খালাস পায়।