ঢাকার সাভারে কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার নেপথ্যে কী- এই প্রশ্নের মধ্যে সন্দেহভাজন স্কুল ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুর সঙ্গে এক ছাত্রীর প্রেমের বিষয়টি উঠে এসেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা এও বলছেন, উৎপলকে পেটাতে পরিকল্পনা করেই স্টাম্প নিয়ে এসেছিলেন জিতু। এটি নিছক ঝোঁকের বসে ঘটিয়ে ফেলা কোনো অপরাধ নয়।
যেখানে শিক্ষককে পেটানো হয়েছে, সেই জায়গাটি কলেজের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতাধীন বলে জিতু ঘটনার আগে আগে মেইন সুইচ বন্ধ করেছেন, যেন কোনো কিছু ক্যামেরায় রেকর্ড না হয়।
সেখানে মেয়েদের যে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল, সেখানে স্টাম্প ব্যবহার করা হয়েছে প্লাস্টিকের। আর সেই শিক্ষককে পেটানো হয়েছে কাঠের স্টাম্প দিয়ে।
আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় নিহত উৎপলের সহকর্মী, শিক্ষার্থী, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্কুলের স্টাফ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে অভিযুক্তের বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পাওয়ায় তার পরিবারের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত শনিবার দুপুরে চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে কলেজের প্রভাষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র জিতুর বিরুদ্ধে।
পিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়া শিক্ষক উৎপল মারা যান পরদিন। এই ঘটনায় জিতুর বিরুদ্ধে মামলা করেন উৎপলের ভাই অসীম কুমার সরকার।
জিতুর দশম শ্রেণিতে পড়লেও তার বয়স ১৯ বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, এই তরুণ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। সেখান থেকে ঝরে পড়ার পর এই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
কলেজের আইসিটি বিভাগের শিক্ষক মনির হোসেন বলেন, ‘জিতু ক্লাস নাইনে আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছিল। এর আগে সাভারের রাজফুলবাড়িয়া এলাকার একটা মাদ্রাসায় পড়ত। সে ছাত্র হিসেবে খুবই দুর্বল প্রকৃতির। উচ্ছৃঙ্খলও। তার বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়েরও অভিযোগ ছিল।’
উৎপলের ওপর কীসের ক্ষোভ জিতুর?
কলেজের সামনের মার্কেটের মালিক ইমান উদ্দিনের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসল ঘটনা এখনও কলেজের শিক্ষকরা বলছেন না। তবে আস্তে আস্তে সব বেরিয়ে আসবে।
‘জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনের ব্যবসায়িক পার্টনার মাজেদ নামে এক ব্যক্তি। তাদের হোটেল ব্যবসা আছে। সেই মাজেদের শ্যালিকার ছোট বোন এই কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ে। তার সঙ্গে জিতুর আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক।
‘কিছুদিন আগেও স্কুলের একটি কক্ষে জিতু ও সেই মেয়েকে দেখার পর শিক্ষক উৎপল তাদেরকে শাসন করেন। ওই মেয়ের পরিবারকে তিনি ফোন করে সব জানিয়ে সতর্কও করেন। মেয়েটা জিতুকে এসব বিষয় জানালে সে ক্ষুব্ধ হয়েই ওই স্যারকে পিটিয়েছে।’
ইমান উদ্দিনের তথ্য বলছে, জিতু এতটাই বেপড়োয়া ছিলেন যে, খেলার আগের দিন থেকেই কলেজের বাইরে স্টাম্প নিয়ে ঘুরছিলেন।
তিনি জানান, সেদিন জিতুর সঙ্গে আরও তিন জন ছিল। পেটানোর পর চার জন এক সঙ্গে হেঁটে চলে যায়।
একই কথা জানান ওই কলেজে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইম ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘স্যার সেই মেয়ের বাসায় ফোন করে শক্তভাবে বিচার দিয়েছিলেন যেন মেয়েটা জিতুর সঙ্গে না মেশে। এটার ক্ষোভ থেকেই জিতু স্যারকে খেলার দিন পিটিয়েছে।’
কলেজের হিসাবরক্ষক পারুল আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু দিন আগে স্কুলের একটি কক্ষে জিতু ও মেয়েটাকে অপ্রীতিকর অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আমরা সেভাবে বিস্তারিত জানি না। মেয়েটা আমাদের কলেজের এক শিক্ষকের ছোট বোন। এর বেশি আর কিছু জানি না আমি।’
সিসিটিভি ফুটেজে কিছুই নেই
কলেজের সিসিটিভি ফুটেজেও আমলার আগে জিতুর নানা কর্মকাণ্ড ধরা পড়েছে। তবে ঘটনার সময়কার কিছুই রেকর্ড হয়নি।
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ঘটনার সময় বিদ্যুত না থাকায় ফুটেজ রেকর্ড হয়নি। সে সময় কলেজের বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পেছনে জিতুর হাত আছে বলেই বিশ্বাস তাদের।
সাভারের আশুলিয়ায় চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ
কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেন, ‘উৎপল কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান ছিলেন। তাই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে তিনি হয়ত শাসন করেছিলেন। তবে ঠিক কোন বিষয়টা, সেটা আমার জানা নেই। আর ওই দিনের ফুটেজের বিষয়টা হলো, আমরা হঠাৎ করে দেখি কারেন্ট চলে গেছে। কিন্তু তখন আশপাশে সব জায়গায় কারেন্ট ছিল। ঘটনার পরপর আমরা বুঝতে পারি, সে (জিতু) পরিকল্পিতভাবেই বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করেছে।’
মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শক করেন আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিয়াউল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কলেজ ও আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ আমরা সংগ্রহের চেষ্টা করছি। কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, ওই দিনের ফুটেজ তাদের নেই। সেই বিষয়গুলোও আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
‘আর খেলায় প্লাস্টিকের স্টাম্প ব্যবহার করা হয়েছে। কাঠের স্টাম্প বাইরে থেকে আনা হয়েছে ঘটনার আগে। সবগুলো বিষয় নিয়েই আমরা কাজ করছি। আসামি গ্রেপ্তার হলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জিতুকে গ্রেপ্তারে তাদের ৪-৫টি দল কাজ করছে। শিগগির তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা যাবে বলেও আশাবাদী তিনি।
নিহত শিক্ষক উৎপল সরকার সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। ৩৫ বছর বয়সী এই শিক্ষক প্রায় ১০ বছর ধরে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকতা করছেন।