ঢাকার সাভারে ছাত্রের স্টাম্পের আঘাতে কলেজশিক্ষক নিহতের ঘটনার তিন দিন পর সেই স্টাম্প ঘটনাস্থল থেকেই জব্দ করেছে পুলিশ। তবে এখনও অভিযুক্ত ছাত্র গ্রেপ্তার হয়নি।
আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত শনিবার দুপুরে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রের বিরুদ্ধে। এর পর থেকে ছেলেটি পলাতক।
এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই দিন ভর্তি থাকার পর সোমবার সকালে উৎপলের মৃত্যু হয়। এর আগে রোববার ওই স্কুলছাত্র ও অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের নামে মামলা করেন উৎপলের ভাই অসীম কুমার সরকার।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই মঙ্গলবার বিকেলে স্টাম্পটি জব্দ করেন আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলাম।
সে সময় সেখানে ছিলেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
স্টাম্প ঘটনাস্থলে থাকা সত্ত্বেও তিন দিন পর তা জব্দ করার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা জিয়াউল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘না, আসলে আলামতটা সিজ করাই ছিল। এখানে ছিল। আমরা নেব, কাজ করতেছি। এটা আমাদের হেফাজতেই আছে। আমরা এখন থানায় নিয়ে যাব।’
অভিযুক্তকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি কেন? জবাবে পরিদর্শক জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘তাকে ধরতে আমাদের চারটি টিম মাঠে কাজ করছে। শিগগিরই ভালো রেজাল্ট পাব।’
এ ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমাম হাসান ভূইয়া।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখনই এ রকম কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন দুইটা জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো ময়নাতদন্ত, আরেকটা হলো সুরতহাল। ময়নাতদন্ত অনেক সময় পরেও হয়। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিনে প্রাইমারি তদন্ত করাটা হলো সুরতহাল।
‘এ ক্ষেত্রে সাক্ষী যারা উপস্থিত থাকবে তাদের স্বাক্ষর নিতে হবে। শুধুমাত্র পুলিশ হলে হবে না। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিজার লিস্ট বা জব্দ তালিকা। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে সার্চ করে যত ধরনের আলামত আছে সেগুলোর একটা জব্দ তালিকা তৈরি করতে হবে। সেখানেও বাধ্যতামূলকভাবে পুলিশের বাইরে অবশ্যই উপস্থিত কোনো উইটনেসের স্বাক্ষর নিতে হবে। যা আইনে স্পষ্ট বলা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে স্টাম্প রিকভারি যদি তিন দিন পরে ঘটনাস্থল থেকেই করা হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে পুলিশের এখানে অবহেলা ছিল। আদারওয়াইজ তারা যখন জানতে পেরেছে যে, স্টাম্প দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তারা অবশ্যই ঘটনাস্থল ভালোভাবে সার্চ করে নাই। এটা নিশ্চিতভাবেই যারা তদন্ত কর্মকর্তা ও যারা ভিজিট করেছে তাদের অবহেলা ছিল।’
আলামত জব্দে দেরি হলে মামলার ক্ষতি হয় কি? জবাবে আইনজীবী বলেন, ‘যখনই আপনি সিজার লিস্ট বা জব্দ তালিকা তৈরি করতে দেরি করবেন, তখন আলামত নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ফলে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করার সুযোগ তৈরি হয়। কারণ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত স্টাম্পটা অন্য কেউ ধরতে পারে বা ভেঙে ফেলতে পারে।’
যা ঘটেছিল
হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা ছেলেদের ফুটবল ও মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি। শনিবার স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। এ সময় প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিল ছেলে শিক্ষার্থীরা।
‘অভিযুক্ত ছাত্রও দ্বিতীয় তলায় ছিল। হঠাৎ সে নেমে মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় উৎপলকে উদ্ধার করে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই আজ (সোমবার) সকালে উৎপলের মৃত্যু হয়।’
অধ্যক্ষ জানান, উৎপলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামে। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন।
দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উৎপল শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং করতেন ও তাদের নানা অপরাধ বা নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিচার করতেন বলে জানান অধ্যক্ষ। তার ধারণা, অভিযুক্ত ছাত্রকেও উৎপল কোনো কারণে শাসন করেছিলেন। সেই ক্ষোভ থেকে ওই কিশোর তার ওপর হামলা করেছে।
নিহতের ভাই ও মামলার বাদী অসীম কুমার সরকার বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি, ওই শিক্ষার্থী মেয়েদের ইভটিজিংসহ নানা উচ্ছৃঙ্খল কাজে অভিযুক্ত। তাকে শাসন করায় আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে সে। আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিহত শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি থাকায় নিয়ম-কানুন মানাতে শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন। তিনি ওই শিক্ষার্থীকেও শাসন করায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের প্রাথমিক ধারণা।’