বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সীতাকুণ্ডে আগুন: ৩ সপ্তাহেও জমা পড়েনি প্রতিবেদন

  •    
  • ২৮ জুন, ২০২২ ১০:৪৭

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের কারণে ক্ষয়গ্রস্তরা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তাদের জীবন এ দেশে সস্তা। এতগুলো প্রাণহানির পরও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা হচ্ছে না, তাদের নামে তো শোকজ করা উচিত। এভাবে চললে তো অন্যরাও মনে করবে, এ রকম কাজ করেও পার পাওয়া যায়। অন্যরা এ ঘটনা দেখে সতর্ক হবে না।’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে সাত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় তিন থেকে সাত দিন বেঁধে দেয়া হয়।

কিন্তু বিস্ফোরণের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। অথচ বিস্ফোরণের পরদিনই তদন্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব কমিটি গঠন করা হয়।

এর আগে গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রথমে আগুন ও পরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সে সময় কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা।

বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে আশপাশের চার-পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কেঁপে ওঠে। ওই রাতেই ঘটনাস্থল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় দুই শতাধিক হতাহতকে।

১৩ জুন পর্যন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রয়েছেন অন্তত ১০ জন। তবে এখন পর্যন্ত আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা জানা যায়নি। ঘটনার তদন্তে পরদিনই গঠন করা হয় সাতটি কমিটি।

৫ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠন করা হয় প্রথম তদন্ত কমিটি। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা থেকে ৯ জনকে কমিটির সদস্য করা হয়।

কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাকির হোসেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. আবু নুর রাশেদ আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল ইসলাম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আকতার, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের মেজর আবু হেনা মো. কাউসার জাহান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক আনিসুর রহমান ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন।

এ কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কমিটির মেয়াদ শেষে পাঁচ দিনের সময় চেয়ে নেয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে রোববার আমাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছু ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় প্রতিবেন জমা দেয়া যায়নি। দ্বিতীয় দফায় আবারও সময় চেয়েছি। আশা করছি, আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আলাদা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান করা হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (স্থানীয় সরকার) বদিউল আলমকে। ৯ সদস্যের এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও এখনও তারা জমা দিতে পারেনি।

কমিটির সদস্য সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাজ চলছে, এখনও শেষ হয়নি। কিছু কাজ বাকি আছে। আগামী সপ্তাহে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।’

জেলা প্রশাসন ও বিভাগীয় প্রশাসনের কমিটিতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি থাকলেও ঘটনা তদন্তে তারাও একটি কমিটি গঠন করে। অধিদপ্তরের সহকারী মহিপরিদর্শক শিপন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তারাও তদন্ত কাজ শেষ করতে পারেনি।

অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের একটি টিম কাজ করছে। আমরাও এখানে আছি। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।’

অগ্নিকাণ্ডের পর কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ১০ কর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও কয়েকজন। ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের দাবি, ডিপোতে রাসায়নিক থাকার কথা তাদের শুরুতে জানানো হয়নি। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেননি তারা। পুরো ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালককে (অপারেশন) প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এই কমিটিও এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানান কমিটির সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমান।

৪ জুনের বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে ৫ জুন বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাবিবুল কবির চৌধুরীকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়। তবে এখনও কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানিয়েছেন স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

ওইদিন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যের ওই কমিটিকে ঘটনা তদন্তে তিন দিন সময় দেয়া হয়। কমিটির প্রধান করা হয় টার্মিনাল কর্মকর্তা খুদরত ই খোদাকে। এই কমিটিও এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন।

একই ঘটনা তদন্তে আলাদা কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফি উদ্দিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে সাত দিন সময় দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে অন্য কমিটিগুলোর পথে হেঁটেছে এই কমিটিও। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও তারাও এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি বলে জানান কমিটির এক সদস্য।

ঘটনার পরদিন সাতটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও ঘটনার তিন সপ্তাহ পরও কোনো প্রতিবেদন জমা না হওয়ায় ঘটনার সঠিক তদন্ত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির রিপোর্ট না দেয়া আমাদের দেশে নৈমিত্তিক ব্যাপার। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা নিতান্তই আই ওয়াশ। জনগণকে বুঝ দেয়ার জন্যই এগুলো করা হয়, রিপোর্ট আর দেয়া হয় না। কিছু রিপোর্ট দেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখে না।

‘বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের কারণে ক্ষয়গ্রস্তরা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। তাদের জীবন এ দেশে সস্তা। এতগুলো প্রাণহানির পরও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা হচ্ছে না, তাদের নামে তো শোকজ করা উচিত। এভাবে চললে তো অন্যরাও মনে করবে, এ রকম কাজ করেও পার পাওয়া যায়। অন্যরা এ ঘটনা দেখে সতর্ক হবে না।’

সনাক-টিআইবি, চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক সভাপতি ড. আনোয়ারা আলম বলেন, ‘ক্রমান্বয়ে একটির পর আরেকটি ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মূলত শ্রমিকরা। আর সবগুলোতেই কোনো না কোনোভাবে মালিকপক্ষ দায়ী। এসব ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলে তো তীরটা মালিকপক্ষের দিকেই যাবে। আমাদের ধারণা এই কারণে, এখানে অদৃশ্য একটি বোঝাপড়া বা লেনদেন কাজ করে। ঘটনা এখনও সবার নজরে আছে, কিছুদিন পর হয়তো অন্য ঘটনার ভিড়ে চাপা পড়ে যাবে। তখন আর কেউ এ ঘটনা নিয়ে কথা বলবে না।’

নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানাধীন (জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপো সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায়। সেখানে গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে আগুন লাগে।

একে একে ছুটে যায় চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা থেকেও পরে যোগ দেয় কয়েকটি ইউনিট। ৫ জুন সকাল পর্যন্ত আগুন নেভাতে আসা ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৫। কিন্তু কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা।

৮৭ ঘণ্টা পর ৮ জুন দুপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভে। আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

এ বিভাগের আরো খবর