অজ্ঞাত প্রাণীর আতঙ্কে রয়েছেন দিনাজপুর সদর উপজেলার চার গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে ওই প্রাণীর কামড়ে চার দিনে সাতজন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
হামলার শিকার গ্রামগুলো হলো দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর, মাহমুদপুর, খামার ঝাড়বাড়ী ও হাজীপাড়া।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অজ্ঞাত প্রাণীর আক্রমণে সাধারণ মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় বন বিভাগে জানানো হলেও কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। বাধ্য হয়ে দিনের বেলা লাঠি, ধারালো অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করছেন এলাকাবাসী।
ইতোমধ্যে একটি শিয়ালকে হত্যা করেছেন স্থানীয়রা।
অজ্ঞাত প্রাণীর হামলায় আহত আরেকজন। ছবি: নিউজবাংলাভুক্তভোগীদের বর্ণনায় ঘটনা
উলিপুর গ্রামে দিনাজপুর শহররক্ষা বাঁধের ওপর হাঁটার সময় সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম হামলার শিকার হন খামার ঝাড়বাড়ী গ্রামের ৫০ বছর বয়সী মোস্তাকিম ইসলাম। অজ্ঞাত ওই প্রাণী মোস্তাকিম ইসলামের ডান পায়ে কামড় দেয়। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে প্রাণীটি পালিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর ওই স্থান থেকে ৫০০ গজ দূরে ওই প্রাণীর হামলার শিকার হন মাহমুদপুর গ্রামের ৫০ বছর বয়সী শরিফুল আলম। তিনি ওই বাঁধের ধারে বসে থাকা অবস্থায় তার বুকে কামড় দেয় প্রাণীটি।
পরদিন মঙ্গলবার সকালে একই বাঁধের কাছে হামলার শিকার হন মাহমুদপুর গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী আসিয়া বেওয়া। হামলার সময় ওই প্রাণী তার বাঁ হাতে ও বাঁ পায়ে কামড় দেয়। এতে তার পায়ে বেশি জখম হয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুদি দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন উলিপুর গ্রামের ২৪ বছর বয়সী সুরাইয়া বেগম। প্রাণীটি তার বাঁ পায়ে কামড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
বুধবার বিকেলে ক্ষেতে কাজ করে বাড়ি ফেরার সময় অজ্ঞাত প্রাণীর হামলার শিকার হন হাজীপাড়ার ৩৫ বছরের নাজমুল ইসলাম। প্রাণীটি তার বাঁ পায়ে কামড় দিয়ে পালিয়ে যায়।
একই দিন সন্ধ্যায় আমবাগান থেকে বাড়ি ফেরার সময় অজানা প্রাণীর হামলার শিকার হন মাহমুদপুর গ্রামের ২১ বছর বয়সী নুর নবী। তার বাঁ পায়ের ঊরুতে কামড় দেয় সেই প্রাণী। পরে প্রাণীটি তার আবারও কামড় দেয়ার জন্য এলে তিনি লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেন।
পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় শহররক্ষা বাঁধের ওপর হামলার শিকার হন উলিপুর গ্রামের ৫৬ বছরের সাইদুর রহমান। প্রাণীটি তার পিঠের দিকে কামড়িয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। স্থানীয়রা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এলে প্রাণীটি পালিয়ে যায়।
হামলার শিকার সবাই দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তবে হামলায় গুরুতর আহত আসিয়া বেওয়াকে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি শিয়াল উলিপুর গ্রামে গেলে স্থানীয়রা ঘেরাও করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে।
হামলার শিকার স্থানীয়রা কেউ কেউ বলছেন হামলা করা প্রাণী শিয়াল, কেউ বলছেন নেকড়ে, আবার কারও মতে সেটি হায়েনা।
হামলার শিকার মোস্তাকিম বলেন, ‘আমার ওপর হামলা করা প্রাণীটি কখনই শিয়াল হতে পারে না। কারণ আমি ছোটবেলা থেকে জানি শিয়াল মানুষকে দেখলে পালিয়ে যায়, যেটা হামলা করেছে শিয়ালের থেকেও অনেকটা বড় ছিল। সম্ভবত হায়েনার মতো ছিল।’
হামলার শিকার নুর নবী বলেন, ‘আমি বুধবার রাতে বাগানে আম কুড়াতে আসছিলাম। পরে বাসায় ফেরার সময় শহররক্ষা বাঁধে ওঠার আগে কয়েকটা নেকড়ে দেখতে পাই। এর কিছুক্ষণ পর একটা নেকড়ে আমার কাছে এসে বাম পায়ের ঊরুতে কামড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। পরে তাকে লাথি মেরে দূরে ফেলে দিলে সেটি পালিয়ে যায়।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হামলার শিকার আসিয়া বেওয়া বলেন, ‘পাথারত গেছিন, গরু বান্দিতে, গরুখান বান্দিনু। তখন শিয়াল খান মোর ওপর ঝাঁপিয়া আসিয়া কামড় দেয়। মুই তখন একখান বাতা দিয়া শিয়ালত বাড়ি দিছু। বাতা খান কাড়ি নিয়া পানিত ফেলায় দিয়া মোর হাতত কামড় দেয়। তখন চিল্লাবার ধরিলে গ্রামের মানুষজন আসিলে শেয়ালক পিটায় দেয়।
‘পরদিন ওই শিয়ালখান আবার গ্রামত আসিয়া একজনক কামড় দিবার তানে আসে, তখন গ্রামের মানুষজন শিয়ালক ধরিয়া বান্দি মারিয়া ফেলছে।’
মাহমুদপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের গ্রামে শিয়ালের কামড়ে অনেকজন আহত হয়েছেন। তাই আমরা কয়েকজন মিলে বন বিভাগের অফিসে গিয়ে অভিযোগ করেছি। তারা কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আমরা এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
এলাকাবাসীর হাতে মারা যাওয়া শিয়াল। ছবি: নিউজবাংলাকী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাসস্থান ও খাদ্যসংকটের ফলে শিয়ালের কামড়ে সাধারণ মানুষ আহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ মোসাদ্দেক হোসেন। বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় শিয়ালের আবাসস্থল বেশি। এরা ঝাড়-জঙ্গলে বেশি বসবাস করে। তারা যুগ যুগ ধরে এই প্রকৃতির জঙ্গলগুলোতে বসবাস করছে। আর এই জঙ্গল থেকে বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তারা।
‘সাম্প্রতিক নগরায়ণের ফলে জঙ্গলের সংখ্যা কমে গেছে। এতে তাদের আবাসস্থল অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি তারা খাদ্যসংকটে পড়ে গেছে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে মানুষের ওপর হামলা করছে।’
বন বিভাগের দিনাজপুর সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘উলিপুরসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েকজন মানুষ আমাদের অফিসে এসে একটা মৌখিক অভিযোগ করেছিল। পরে আমাদের একটি টিম ওই এলাকায় গিয়েছিল। আমাদের টিম ওই এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছে। দুই থেকে তিন দিন শিয়ালের কামড়ের কথা শোনা গেলেও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
“পুনরায় যদি কেউ শিয়ালের কামড়ে আক্রান্ত হয় তাহলে আমাদের জানানোর জন্য বলেছি। তবে কোনো শিয়াল ‘রেবিস’ নামক রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণ মানুষকে কামড় দিতে পারে।”