বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পদ্মা সেতু নিয়েছে জমি, দিয়েছে অহংকার

  •    
  • ২৫ জুন, ২০২২ ২০:০১

পদ্মা সেতুর জন্য বাবুল শেষ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জমি দিয়েছেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পায় তার পরিবার। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ বাবদ তারা পান ২১ লাখ ৬ হাজার ৪১৫ টাকা।

আলোয় উদ্ভাসিত রাতের পদ্মা সেতু। প্রতিবিম্ব পদ্মার বুকে তৈরি করেছে অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। নিজ ঘর ছেড়ে মৃদু পায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ান ৪২ বছর বয়সী বাবুল হাওলাদার। দুই চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুধারা।

বাংলাদেশের অহংকার হয়ে প্রমত্তা পদ্মাকে পরাস্ত করে দুই প্রান্তের সংযোগ ঘটিয়েছে যে সেতু, তার নাড়ির টান বাবুল হাওলাদারের। আরও অনেকের মতো তার পৈতৃক জমি এই সেতুর জন্য করা হয়েছে অধিগ্রহণ। ফলে পদ্মা সেতু কেবল একটি স্টিল-কংক্রিটের কাঠামো নয়, বাবুলের কাছে এই সেতু যেন আপন সন্তানতুল্য।

জাজিরা প্রান্তের ১০১ নম্বর নাওডোবা মৌজার ১০৪৯ নম্বর খতিয়ানের ৪৩৪৯ নম্বর দাগে পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজার আগে ভায়াডাক্টের সর্বশেষ পিলারের জায়গায় ছিল বাবুল হাওলাদারের বসতি। ৯ দশমিক ৮১ একর জমিতে বসতবাড়ির পাশাপাশি ছিল কৃষিজমি।

সেই জমিতে কৃষিকাজ করত বাবুলের পরিবার। পাশাপাশি ঢাকার শ্যামবাজারে হকারের কাজ করতেন বাবুল। ২০০৬ সালের শেষ দিকের কথা। বাবা লাল মিয়া হাওলাদার মোবাইল ফোনে বাবুলকে জানান তাদের জমি থেকে পাঁচ একর জায়গা পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়ার শঙ্কায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবুলের।

তবে নিজেকে সামলে নেন দিন কয়েকের মধ্যেই, বুঝতে পারেন তার মতো আরও অনেকের ত্যাগের মধ্য দিয়েই দক্ষিণের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচিত হবে।

পদ্মা সেতুর জন্য বাবুল শেষ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জমি দিয়েছেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জমি অধিগ্রহণের নোটিশ পায় তার পরিবার। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ বাবদ তারা পান ২১ লাখ ৬ হাজার ৪১৫ টাকা।

তারপর কেটে গেছে প্রায় ১১ বছর। বাবুলের চোখের সামনে ধীরে ধীরে পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বকে অবাক করে দেয়া বাংলাদেশের গর্বের গল্প।

রাতের ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে আলো ঝলমলে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে সেই সব দিনের স্মৃতিতাড়িত হন বাবুল।

নিউজবাংলাকে শোনান, প্রথম কয়েক দিনের টানাপড়েন আর এখনকার গর্ব-আনন্দের নানা কথা। পদ্মা সেতু নিয়ে প্রথম দিককার ষড়যন্ত্রে বাবুল হাওলাদারও ভেঙে পড়েছিলেন। তবে কি তার মতো আরও অনেকের ত্যাগ আর দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন বিফলে যাবে? বাবুল বলেন, ‘জমি দেয়ার পর জানতে পারলাম সেতু নিয়া ষড়যন্ত্র হইতাছে। বিদেশিরা নাকি টাকা দিব না। তহন ভাবছিলাম পদ্মা সেতু মনে অয় অইব না। কিন্তু আইজ এই সেতু এভাবে দেইখা খুবই আনন্দ লাগতাছে।’

বাবুলের মতোই এমন অসংখ্য গল্পের নায়ক পদ্মাপারের খেটে খাওয়া অসংখ্য মানুষ। পৈতৃক জমি অধিগ্রহণের পর তাদের অনেকের আশ্রয় হয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রে। নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রের মো. আজাহারের বয়স ৬৫ বছর। সেতুর কারণে জমি হারানোর কষ্ট ভুলে গেছেন অনেক আগেই।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০০৭ সালে প্রথম যখন আমাগো জমি অধিগ্রহণ করল, তখন খুবই খারাপ লাগতেছিল। পরে যখন টাকা-পয়সা দিল আর থাকার জন্য একটা প্লট দিল, তখন থেকে মন ভালো হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হইতাছে, দেশের অনেক উন্নতি হইব। আমাগো সব কষ্ট দূর হইয়া গেছে।’

পদ্মা সেতুর কারণে জমি হারানোদের সবাইকে পুনর্বাসন করেছে সরকার। তাদের সবাই আছেন আগের চেয়ে সচ্ছল জীবনে।

পুনর্বাসন কেন্দ্রের ৩৮ বছর বয়সী মাকসুদা বেগম বলেন, ‘দ্যাশের একটা বড় কাজের লিগ্যা জমি ছাইড়া দিছি। সরকার আমাগো জমির লিগ্যা টাহাও দিছে। আবার থাকোইন্যা ব্যবস্থাও কইরা দিছে। ঢাহা (ঢাকা) শহরের মতো পানি টিপ দিলেই পড়তে থাকে। কারেন আছে। হাসপাতালে গেলে ওষুদ-বড়ি দেয়। এহানের স্কুলে পোলাপাইনে লেহাপরা করাইতে পারি। এইহানে অনেক ভালো আছি।’

পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, ‘পোলাইনের পড়ালেখার জন্য সুন্দর বিদ্যালয় আছে। যারা কাজ শিখতে চায় তাদের জন্য গাড়ি চালানোর ট্রেনিং দিয়া আবার চাকরিও দিয়া দিছে। মেয়েছেলেরা শিলাইয়ের (টেইলারিং) কাজ শিখছে। অহন তারা জামাকাপড় বানাইয়া টাকা কামাই করতে পারে।’

পদ্মার বুকে এখন সগর্বে দাঁড়ানো পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর দিকের পথ ছিল ভয়ংকর পিচ্ছিল। আড়াই দশক আগেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এই নদীর ওপর সেতু ছিল কষ্টকল্পনা।

পদ্মার ওপর সেতু তৈরির দাবিতে আশির দশকে প্রথম আনুষ্ঠানিক আন্দোলনে নামেন ছাবেদুর রহমান খোকা সিকদার। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের এই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এখন শরীয়তপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।

খোকা সিকদার নিউজবাংলাকে বলেন, সে সময়ে আন্দোলনের মূল প্রেরণা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি নিজে ডেকে নিয়ে আন্দোলনে উৎসাহ দিয়েছেন।

খোকা সিকদার বলেন, এ আন্দোলনের কারণে নানান বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। অনেকে তাকে পাগল বলেও উপহাস করেছেন।

খোকা সিকদারসহ আরও কিছু মানুষের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখার সুযোগ পায় আন্দোলন শুরুর এক দশকেরও পর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯৯৯ সালে শুরু হয় প্রাক-সম্ভাব্যতা জরিপ। এরপর ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়ায় সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে। শুরু হয় বিদেশি দাতাদের যুক্ত করার কাজ।

মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের কারিগরি মূল্যায়ন ও সুপারভিশন কনসালট্যান্সির প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠন হয় মূল্যায়ন কমিটি।

পদ্মার ওপর সেতু নিয়ে গোটা জাতি যখন স্বপ্নে বিহ্বল, ঠিক তখন আকস্মিকভাবে প্রকল্পে দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ তুলে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। অন্য বিদেশি দাতারাও একই পথ অনুসরণ করে। অনিশ্চয়তায় পড়ে পুরো প্রকল্প।

তবে থেমে যায়নি বাংলাদেশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় দৃঢ়তায় নিজস্ব অর্থায়নেই শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ। কঠিন সেই সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা নিউজবাংলাকে বলছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি শুরু থেকে এই প্রকল্পে ছিলাম না। এখানে এসেছি ২০১১ সালের নভেম্বরে। বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার কারণে ক্রাইসিস তৈরি হলো। তখন আমাদের সে সময়ের সচিব, প্রকল্প পরিচালক, এমনকি মন্ত্রীও চলে গেছেন। ওই সময়ে আমি এলাম আর একজন নতুন মন্ত্রী ও নতুন সচিবও এলেন দায়িত্বে। ততদিনে ডিজাইন শেষ হয়েছে, টেন্ডার শেষ হুয়েছে, প্রি-কোয়ালিফিকেশনও শেষ হয়েছে। সরকার বলল, যেখানে থেকে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে আমরা শুরু করব।

‘আমরা কিছু ফাউন্ডেশন পেয়েছি, একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছি এটা বলা ঠিক হবে না। ভুল হবে। নির্মাণকাজের শুরুটা আমাদের সময়ের। তার মানে ফুল টেন্ডার, টেন্ডার প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন আমাদের হাতে হয়েছে।

‘বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন হলো প্রকিউরমেন্ট। প্রকিউরমেন্টে অনেক গন্ডগোল লাগে, মামলা-মোকদ্দমা হয়, এটা-সেটা অনেক কিছু হয়। এই প্রকল্পে ওসব কিছু ওভারকাম করে আমরা নির্মাণকাজ করতে পেরেছি।’

এত বড় প্রকল্প নিজেদের টাকায় আর কখনও করেনি বাংলাদেশ। ফলে বিপুল অর্থের জোগান নিশ্চিত করাই ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে সেই টাকার জোগান এলো- বলছিলেন শফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “ওটা অচলাবস্থা ঠিক আছে, কিন্তু আমরা সব মহল থেকে সহায়তা পেয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের বললেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করব। অনেকের প্রশ্ন ছিল যে নিজস্ব অর্থায়ন কীভাবে সম্ভব? কারণ আমাদের বাজেটের আকার এমন, এটা হলে সব উন্নয়ন থমকে যাবে। একই সঙ্গে এত ফরেন কারেন্সি আমরা কোথায় পাব? ৮০ ভাগ ফরেন কারেন্সি, আড়াই বিলিয়ন ডলার ফরেন কারেন্সি লাগবে। এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় কাজ করেছে।

“তখন আমি মিটিং করেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে। আমার ব্যাংকার ছিল অগ্রণী ব্যাংক। তাদের দুই জিএম সাহেবকে নিয়ে আমি গেলাম। তারপর ওনাকে ব্যাখ্যা করলাম যে টাকা তো আমাদের একবারে লাগবে না। চার-পাঁচ বছরে টাকাটা লাগবে।

“শুনতে আড়াই বিলিয়ন ডলার মনে হলেও এটা তো আর একসঙ্গে লাগছে না। বাংলাদেশের তখনকার বাজেটের হয়তো একটা বড় অংশ। তবে পরের বাজেটে কিন্তু এটা কমে আসবে, কারণ বাজেট বড় হচ্ছে। আমার সেতুর বাজেট তো আর সামনে বাড়বে না।

“ওনারা কনভিনসড হলেন। অগ্রণী ব্যাংক বলল, যে টাকাটা লাগবে তারা দিতে পারবে। আমি বললাম, আমার এক মাসে ম্যাক্সিমাম ২০০ মিলিয়ন ডলার লাগতে পারে। তখন অগ্রণী ব্যাংক বলল, তারা এটা দিতে পারবে। গভর্নর সাহেব খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে ফাইন। তাহলে তো আমার ওপর কোনো চাপই নেই। লাগলে আমি আপনাকে সাহায্য করব।’

“পরে বিষয়টা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা করলাম। তারাও দেখল টাকা তো আর একবারে লাগছে না। আমাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়ল যে আমরা এটার অর্থ দিতে পারব। ফরেন কারেন্সির জন্য কোনো সমস্যা হবে না।”

এভাবেই অনিশ্চয়তার পাহাড় ডিঙিয়ে যাত্রা শুরু স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। কেবল অর্থায়ন নয়, প্রমত্তা পদ্মা বহু দিক থেকে বিশ্বের অনন্য এক নদী। তাই এর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণে পেরোতে হয়েছে অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ।

শফিকুল বলেন, ‘এখানে পানির স্রোত অনেক বেশি। কারণ দুটি নদীর সম্মিলন ঘটেছে এখানে । আমরা এর আগে পদ্মাতেও ব্রিজ করেছি, যমুনাতেও করেছি। লালন শাহ ব্রিজ করেছি পদ্মায়, আর যমুনায় করেছি বঙ্গবন্ধু সেতু। তবে এখানে কিন্তু ওই দুইটা নদীর কম্বিনেশন।

‘সাধারণ সেন্সই তো বলবে দুই নদীর স্রোত যখন এক জায়গায় আসে, তখন সমস্যা এমনিতেই বেশি হবে। যমুনায় আমরা তলদেশে ৮০ মিটার যাওয়ার পর হার্ড লেয়ার পেয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে এর থেকে মজার আর ভালো কিছুই হতে পারে না। আর এখানে আমরা ১৪০ মিটার গিয়েও হার্ড লেয়ার পাচ্ছি না। সে ক্ষেত্রে বিয়ারিংয়ের জন্য আমার অন্যান্য মেথড খাটাতে হয়েছে। যে কারণে অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।’

পদ্মার তলদেশের নরম মাটির স্তর অনেক ভুগিয়েছে প্রকৌশলীদের। প্রকল্প সফল করতে নিতে হয়েছে নতুন পরিকল্পনা। যার অনেক কিছুই বিশ্বে এই প্রথম।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাটির ভিন্নতা থাকার কারণে ২২টি পিয়ারে আমরা বিয়ারিং ক্যাপাসিটি পাইনি। পরে আবার ডিজাইন করা হয়েছে। সেখানে ছয়টির জায়গায় সাতটি পাইল দেয়া হয়েছে। তার পরও আমাদের বিয়ারিং আসছিল না। তখন আমরা একটা নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করেছি। সেটার নাম গ্রাউটিং, যেটা আগে বাংলাদেশে ব্যবহার হয়নি।

‘আবার যে সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আগে বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়নি। মাইক্রোফাইন সিমেন্ট, যেটা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে। এই সিমেন্ট আর গ্রাউটিং দিয়ে বিয়ারিং ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়েছে।

‘এর পরও আমরা কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। শুধু থিওরিটিক্যালি দেখলে আসলে হবে না, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তো প্র্যাকটিক্যাল বিষয়। আপনারা দেখবেন পাইলিংয়ের লোড টেস্ট হয়। বিল্ডিং বানাতে গেলেও লোড টেস্ট করে। ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে ডিজাইন করে দেন পাইলের লেন্থ এত হবে। সেটা হওয়ার পর কিন্তু আবার লোড টেস্ট করে যে থিওরিটিক্যাল ক্যালকুলেশন বাস্তবের সঙ্গে মিলছে কি না। আমরাও তেমন টেস্ট করেছি এবং সেটায় ভালো ফল আসছে। এরপর আত্মবিশ্বাস আরও বাড়াতে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো টেস্ট করেছি। এটা বিশ্বে শুধু পদ্মা সেতুতেই হয়েছে। সেটাতেও ভালো ফল আসায় আমরা কনফার্ম হয়েছি, হ্যাঁ এখন এটাতে যেতে পারি।’

পদ্মা সেতুতে ১২০ মিটার পাইল বিশ্বরেকর্ড। একই সঙ্গে গ্রাউটিং টেকনোলজি ও মাইক্রোফাইন সিমেন্ট দেয়াও বিশ্বরেকর্ড। আরও বেশ কিছু অনন্য প্রযুক্তি রয়েছে এই সেতুতে।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য বিয়ারিং ব্যবহার করেছি ৯০ দশমিক ৬ হাজার কিলো ইউনিট টন, মানে সবচেয়ে বড়। পৃথিবীতে এত বড় বিয়ারিং আর কোনো সেতুতে ব্যবহার হয়নি। নদীশাসনের ক্ষেত্রেও বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। এখানে ২৮ মিটার ডেপথে এত বড় দৈর্ঘ্যে নদীশাসন আর কোথাও হয়নি।‘

এই সেতু নির্মাণে বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানো কিছু সরঞ্জামও ব্যবহার করা হয়েছে। এদিক থেকেও বিশেষত্ব রয়েছে পদ্মা সেতুর।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যে ক্রেনটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা পাঁচ হাজার টন ক্যাপাসিটির। এর নাম তিয়ানি; চাইনিজ একটি ক্রেন। এটি পৃথিবীর অন্যতম বড় ক্রেন। সবচেয়ে বড় ক্রেন কি না জানা নেই। যেহেতু আমাদের স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। তাই এর চেয়ে বেশি ক্যাপাসিটির ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে।

‘এ সেতুর ব্যবহৃত হ্যামারটাও বিশেষ হ্যামার। যমুনাতেও একই কোম্পানির হ্যামার ব্যবহার হয়েছিল, তবে সেটা এত বড় ছিল না। এখানে যেহেতু ডেপথ বেশি, তাই হ্যামারের ক্যাপাসিটিও বেশি লেগেছে।’

বিশেষজ্ঞদের কাছে পদ্মা সেতু শুধু একটি যোগাযোগের বড় মাধ্যম নয়, এটা এক আবেগ ও ভালোবাসারও নাম। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দেশে রূপান্তরকামী এক চেতনা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হকের কাছে পদ্মা সেতু দেশ রূপান্তরকারী একটি প্রকল্প, এটা দেশের সক্ষমতার প্রতীক।

তিনি বলেন, ‘পদ্মা ব্রিজ না থাকার ফলে আমাদের দেশটা দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ঢাকার এত কাছে থাকার পরও বিনিয়োগ ও উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল। এটা একটা বৈষম্য ছিল। খুলনা ঐতিহাসিকভাবে একটা শিল্পাঞ্চল ছিল। সবচেয়ে পুরোনো মোংলা পোর্ট ছিল। কুয়াকাটা হয়েছে। এদের সংযোগকারী যে অবকাঠামো দরকার ছিল সেটাই পদ্মা সেতু।’

পদ্মা সেতুর নির্মাণকৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক নিয়েও মুগ্ধ ড. সামছুল হক। তিনি বলছেন, সেতুর নির্মাণকৌশল দেখতে গেলে বিজ্ঞানের আশীর্বাদই সামনে ভেসে ওঠে।

ড. সামছুল হক বলেন, ‘আমরা যদি দেশের উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দিকে তাকাই, তবে দেখতে পাব সেখানে ট্র্যাডিশনাল প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটেছে। লোহা, নাট-বল্টু ব্যবহৃত হয়েছে। ওই সেতুটার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সময়-অর্থ ও জনবলের প্রয়োজন হয়। নাট-বল্টু ও রেবেটিং থাকলে সেগুলো ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। সেতু যত পুরোনো হতে থাকে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা খরচও তত বাড়তে থাকে।

এই সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামোগত অভূত পরিবর্তন দেখা দেবে বলে আশা করেন ড. সামছুল হক।

তিনি বলেন, ‘ঢাকা-মাওয়া যে এক্সপ্রেসওয়েটা, সেটা বড় ধরনের যোগাযোগের ও সংযোগের জন্য সহায়ক। যে কারণে অর্থনৈতিক সার্বিক উন্নতির পাশাপাশি যোগাযোগ উন্নয়ন ও পর্যটনের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এ সেতু প্রভাব রাখবে। পর্যটন এমন একটা খাত, যেটার সঙ্গে ৩১টি খাত একই সঙ্গে চাঙা হয়। সেদিক থেকে পদ্মা ব্রিজ আমাদের অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছে। যমুনা ব্রিজের যে উন্নয়ন ছিল, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সেটার গতি ছিল ধীর। এখন আমাদের উদ্যোক্তারা অনেক সাহসী। ঢাকা অনেক কাছে। সে কারণে উন্নয়নটা আরও বেশি হবে। এর সঙ্গে যে রেলসেতু হবে, সেটাও যোগাযোগের বহুমাত্রিকতা নিয়ে আসবে। যাত্রী পরিবহন ও পায়রা বন্দর থেকে কনটেইনার বহনের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, অনেক দিক থেকেই বলিষ্ঠ উন্নয়ন হবে।’

জাজিরার বাবুল হাওলাদারের মতো কয়েক হাজার পরিবারের ভিটেমাটি অধিগ্রহণ হয়েছে পদ্মা সেতুর জন্য। তবে তা নিয়ে বাবুলের আক্ষেপ নেই, বরং গোটা বাংলাদেশের গৌরবের সামনের সারিতে নিজেকে ভাবছেন তিনি।

রাতের ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে আলো ঝলমলে পদ্মা সেতু বাবুলের চোখে বইয়ে দেয় আনন্দ অশ্রু। অতীতের স্মৃতিতাড়িত বাবুল স্বপ্ন দেখেন আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। এই সমৃদ্ধির মেরুদণ্ড হিসেবে পদ্মার ওপর দিয়ে গড়ে উঠেছে সেতু। বাবুল হওলাদারের অহংকারের সেতু এখন গোটা বাংলাদেশের অহংকার।

এ বিভাগের আরো খবর