বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনায় বিদ্ধ হলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূস। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে শনিবার পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে সুধী সমাবেশে দেয়া বক্তব্যে তিনি ইউনূসের সমালোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল এই সেতু নির্মাণ নিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। আমিও আনন্দিত ও গর্বিত, উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমরা আজ এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি।
‘পদ্মা সেতু শুধুই একটি সেতু নয়। এই সেতু দুপারে যে বন্ধন তৈরি করেছে তা-ও নয়, এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্টের তৈরি একটি অবকাঠামো নয়; এই সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব।’
‘এই সেতু আমাদের সক্ষমতা, আমাদের মর্যাদার শক্তি। এই সেতু জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা ও সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের কারণে এই সেতু নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি, হতাশ হইনি। এবং শেষ পর্যন্ত সব অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। আজকে পদ্মার বুকে লাল-নীল আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ, এই স্তম্ভ যেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৭ সালে আমি জাপান সফরে গিয়েছিলাম। তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম- রূপসা ও পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে চাই। আমি জানি পদ্মা অত্যন্ত খরস্রোতা নদী। সেই নদীতে সেতু করা অনেক কঠিন। জাপান তখন ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করে এবং রূপসা সেতু নির্মাণ করে দেয়।
‘খরস্রোতা পদ্মার যে ফিজিবিলিটি হয় তার রিপোর্ট ২০০১ সালে আমাদের দেয়। তারই ভিত্তিতে প্রথম মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন করি। ২০০১-এ আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। তারা এই সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়ে জাপানকে আবার সমীক্ষা করতে বলে মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত। জাপান পুনরায় সেটি করে একই মত দেয় যে দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলার সঙ্গে সংযোগের জন্য মাওয়া থেকে সেতুটা নির্মাণ হলে সবচেয়ে কার্যকর হবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘তাদের এই মতের পর স্বাভাবিকভাবে বিএনপি আর এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় আসার পর সিদ্ধান্ত নেই জাপানের সমীক্ষার ভিত্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার। সরকার গঠনের মাত্র ২২ দিনের মধ্যে নকশা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ দেই। অনেক আলোচনার পর যখন কিভাবে অর্থ সংগ্রহ হবে সে উদ্যোগ চলছে তখন বিশ্বব্যাংকও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে টাকা দিতে রাজি হয়।’
‘কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এটা আমাদের জন্য অনেক লজ্জার যে আমাদের দেশের কোনো এক স্বনামধন্য ব্যক্তি, তিনি একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন…। যেহেতু তার বয়স এমডি পদে থাকার জন্য…. তখন আইনগতভাবে একজন এমডি থাকতে পারেন ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু তার বয়স ৭০ বছর হয়ে গেছে, তখনও তিনি এমডি পদে বহাল। বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে বলেছিল- আপনি তো এভাবে থাকতে পারেন না। তাকে তখন ওই ব্যাংকের উপদেষ্টা ইমেরিটাস করার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ক্ষেপে যান।’
ড. ইউনূসের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে, আমাদের অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলায় তিনি হেরে যান। এরপর আমরা দেখলাম বিশ্বব্যাংক আমাদের অর্থ বন্ধ করে দিলো দুর্নীতির অভিযোগে। যখন আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম। যা হোক, আমরা থেমে যাইনি।’
‘পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি আমরা করতে পারি না, করব না। কাজেই অনেক পানি ঘোলা, অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক কিছু মোকাবিলা করলাম। এর সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক জ্ঞানী-গুণী, তাদের নানা ধরনের মতামত। এমন একটি পরিস্থিতি যে পদ্মা সেতুতে তখন কোনো টাকাই ছাড় হয়নি। বিশ্বব্যাংক মামলা করল। পরে কানাডার আদালত রায় দিল- বিশ্বব্যাংকের সব অভিযোগ ভুয়া, কোনো দুর্নীতি এখানে হয়নি। তারপর অবশ্য তারা থেমে যায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের দেশ। এদেশ আমার বাবা স্বাধীন করেছেন। এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাকে আমরা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। কাজেই যতোই অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করুক…। সে সঙ্গে আমার ও রেহানার ছেলেমেয়েদের ওপরও কম ধকল যায়নি। সে বিষয়ে আর আজকে বলতে চাই না।
‘শুধু এটুকুই বলবো, যখন সব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়াল আমি তখন পার্লামেন্টে ঘোষণা দিলাম- পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় করবো, নিজস্ব অর্থায়নে করবো। এ ঘোষণার পর আমার দেশবাসী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম। মানুষের শক্তি বড় শক্তি, সেই শক্তি নিয়েই এই সেতুর নির্মাণ কাজ আমি শুরু করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকের মন্তব্য ছিলো, নিজস্ব অর্থায়নে আবার কিভাবে করব? ধারণা ছিলো এই বাংলাদেশ সারাজীবন পরনির্ভরশীল থাকবে, আর অন্যের দয়ার ওপরই চলতে হবে। জাতির পিতা আমাদের শিখিয়েছেন আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। সেদিন তারা শুধু আমার পাশে দাঁড়ায়নি, অনেকে অর্থ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যে যতটুকু পেরেছিলেন। আমি বলেছিলাম- আমরা বাজেট থেকে করতে পারবো, ওটাও তো জনগণেরই টাকা। আল্লাহর রহমতে আমরা সেটাই করেছি।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘যারা তখন বলেছিলেন- এটা হবে না, নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভব না, এটা একটা স্বপ্ন মাত্র, এটার বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ইত্যাদি…। যা হোক আমার কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অনুযোগ নেই।
‘তাদের চিন্তার দৈন্য আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্য আছে। আমি মনে করি এতে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে আমার সাহসের ঠিকানা, তাই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। আশা করি এ সেতুর কাজ বন্ধ করতে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, তাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, দেশের মানুষের প্রতি তারা দায়িত্ববান হবে।’