২০১৯ সালের ২৫ জুলাই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স রাত ৮টার দিকে পৌঁছায় পদ্মার কাঁঠালবাড়ি প্রান্তের ১ নম্বর ফেরিঘাটে।
উন্নত চিকিৎসার জন্য তিতাসকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা।
তবে এটুআই প্রকল্পে কর্মরত যুগ্ম-সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাবেন বলে ফেরি আটকে অপেক্ষা করতে থাকে ঘাট কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন ঘণ্টা পর সবুর মণ্ডল ঘাটে পৌঁছালে ফেরি ছাড়ে। অ্যাম্বুলেন্সটিও ফেরিতে ওঠার সুযোগ পায়। তবে এরই মধ্যে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণে ফেরিতেই মারা যায় তিতাস।
তিতাতের মৃত্যুর ঘটনা আলোড়ন তোলে দেশব্যাপী। পরে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেনসহ তিনজনকে দায়ী করে হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। তাতে অবশ্য যুগ্ম-সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলকে দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
ঢাকার পথে যাত্রায় পদ্মার মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে যুগের পর যুগ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। দুর্ভোগ অনেক সময়ে হয়েছে প্রাণঘাতী। পদ্মা পাড়ি দিতেও প্রাণহানি হয়েছে অসংখ্য।
শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌপথ। ঘরির কাঁটা ১৮ জুন মধ্যরাত পেরিয়ে সাড়ে ৩টা। শরীয়তপুরের জাজিরা অংশে পদ্মা নদীর টার্নিং পয়েন্টে তীব্র স্রোতের মাঝে বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়া ফেরির সংঘর্ষ।
এই দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় ৪০ বছর বয়সী পিকআপ ভ্যান চালক খোকন শিকদারের প্রাণ। খোকনের বাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া থানার চিংবাখালি গ্রামে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাত্র কয়েক দিন আগে খোকন শিকদার হতভাগ্য মানুষের তালিকায় আরও একটি সংখ্যা যোগ করেছেন। পদ্মার দুই পারের মানুষ বলছেন, স্বপ্নের সেতু নৌযাত্রার বিভীষিকাময় এই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটাতে চলেছে।
তারা বলছেন, সেতু চালু হওয়ার পরেও স্থানীয়ভাবে চালু থাকবে ফেরি ও লঞ্চ পরিবহন ব্যবস্থা। তবে ঢাকা থেকে দক্ষিণের পথে যাত্রায় প্রায় সবাই ব্যবহার করবেন পদ্মা সেতু। ফেরি, লঞ্চ বা স্পিডবোটে বিপদসংকুল পদ্মা পারির অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আর হতে হবে না।
২০১৪ সালে আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চ। ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
এই পথে নদী পারাপারের সময়ে প্রাণ হারানো মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। তবে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও স্থানীয় নৌ-পুলিশের অনানুষ্ঠানিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে পদ্মায় বিভিন্ন নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। নিখোঁজ আছেন অনেকে।
এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালের। সে বছরের ৪ আগস্ট আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। সরকারি হিসেবে, দুর্ঘটনার পর ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ ৬৪ জন। উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে ২১ জনকে মাদারীপুরের শিবচর পৌর কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। গত আট বছরেও তাদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। হদিস পাওয়া যায়নি দুর্ঘটনার শিকার পিনাক-৬ লঞ্চটির।
গত বছরের ৩ মে কাঁঠালবাড়ীর বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে পদ্মানদীতে যাত্রীবোঝাই স্পিডবোট বালু বোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে তিন শিশুসহ ২৬ যাত্রী মারা যান। একই বছর মাত্র ১০ দিনের মাথায় ১২ মে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটের পদ্মা নদীতে একটি রোরো ফেরিতে প্রখর রোদের তাপে পাঁচ জন যাত্রী প্রাণ হারান। এনায়েতপুরী নামের ফেরিটি ঘাটে পৌঁছানোর পর জ্ঞান হারানো অর্ধশতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া প্রায় প্রতি বছর পদ্মায় স্পিডবোটে উল্টে বা দুটি স্পিডবোটের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে। ট্রালারডুবিও হয়েছে অনেকবার।
শিবচর উপজেলার চরজানাজাত নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহানুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নৌ-দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। ছোট-বড় কোনো দুঘর্টনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিই। কোথাও নৌপথে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নিই। এর বাইরে তেমন কিছু করার নেই।’
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মাসুদ পারভেজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদ্মা পারাপারের সময় কত যে মায়ের বুক খালি হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। চরম ভোগান্তি ও ঝুঁকি নিয়ে এত দিন ধরে এই রুটে যাত্রীরা চলাচল করছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু স্বজনহারাদের দুঃখ কিছুটা হলেও ঘুঁচাবে।’
মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ইয়াকুব খান শিশির বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌ-রুটে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচলের ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। এ কারণেই বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা সেতুর কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে আসবে।’