বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পদ্মার বুকে গর্বিত বাংলাদেশের অহংকারের স্মারক

  •    
  • ২৪ জুন, ২০২২ ১১:১৫

দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপোড়েনের জের ধরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। পরে নিজস্ব অর্থায়নেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে। এভাবেই নিজস্ব শক্তিতে প্রমত্ত পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে গর্বিত বাংলাদেশের অহংকার।

এ যেন এক যুদ্ধ। তাদের কোনো রাত-দিন নেই। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম এমনকি রোদ-বৃষ্টিকে থোড়াইকেয়ার। নেই করোনা অতিমারিতে আতঙ্কনীল হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ। আছে শুধু কাজ শেষ করার অদম্য ক্ষুধা। স্বপ্নে সঞ্জীবিত কর্মীরা নিরলস, যেন ব্রতে ব্যাপৃত। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে ইতিহাসের অংশ হওয়ার অঙ্গীকার সবার।

কারও চোখেমুখে নেই ক্লান্তির ছাপ। আছে আনন্দের ঝিলিক আর অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার বুকভরা সাহস। এইসব মেহনতি ঘাম ও নিষ্ঠার গাঁথুনিতে প্রমত্ত পদ্মাকে জয় করে প্রায় এক যুগে গড়ে উঠেছে গর্বিত বাংলাদেশের অহংকার দ্বিতল মহাসেতু।

এই সেতু চালু হওয়ায় ৫৫ কিলোমিটারের এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারসংলগ্ন গোলচত্বর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪০-৪৫ মিনিট। সরকারের প্রত্যাশা, এই সেতু হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে।ভায়াডাক্ট ছাড়া ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চার লেনে চলবে গাড়ি, এক বছর পর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদিত যেকোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে অনায়াসে। সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যে লাইন দিয়ে গ্যাস পৌঁছাবে এই জনপদসহ আশপাশের অনেক জেলায়।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু ও নদীশাসন কাজ উদ্বোধন করেন। এর আগে ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি শুরু হয় নকশা ও পুনর্বাসন কাজ।

উপহাস আর ষড়যন্ত্রের কথাদেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতির স্বপ্ন এখন বাস্তব। পদ্মা সেতু যাতে না হয় সে জন্য বিদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন দেশেরও অনেকে। কয়েকটি সংবাদপত্রে দিনের পর দিন পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতি নিয়ে মনগড়া গল্প প্রকাশ হয়েছে। তবে এসব গল্প উড়িয়ে দিয়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত বলেছে, এই মামলায় যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।

দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপোড়েনের জের ধরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। পরে নিজস্ব অর্থায়নেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে।

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদার নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, এই সেতু নিয়ে ৯০ দশকের আন্দোলন এবং আন্দোলনের কারণে অনেক মানুষের টিটকারী, হাসি-তামাশার শিকার হওয়ার কথা। অনেকে তাকে পাগল হিসেবেও উপহাস করেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে শরীয়তপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকা খোকা শিকদার জানিয়েছেন, আন্দোলনের এই পুরো সময়ে ক্ষমতায় ছিল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। তিনি বলেন, ‘২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। তারপর বিএনপি সরকার এসে সেটা ভেঙে ফেলে। তারপরের ইতিহাস সবাই জানেন। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা নিজেদের টাকা দিয়ে নিজেই পদ্মা সেতু করলেন।’

নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলার সময় পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা তুলে ধরার পাশাপাশি পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কমিটির বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি, নানা ধরনের উপহাস আর ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ তোলেন শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।

উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। যুক্ত হই ছাবেদুর রহমান খোকা শিকদারের নেতৃত্বাধীন পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কমিটিতে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এই সেতুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিই। সে সময় এই সেতুর কথা বলে আজকের বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা পর্যন্ত উপহাস করেছিলেন।

‘নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন পদ্মা সেতু ঠেকাতে। কিন্তু দেশপ্রেমে বলীয়ান শেখ হাসিনাকে কেউ দমাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নদী পার হয়ে জাজিরায় গেছেন। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য চষে বেরিয়েছেন এই জনপদ। আজ সেই নদীর বুক চিরে পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে যেন বঙ্গবন্ধুকেই কুর্নিশ করছে। এই সেতুর ফলে এখানকার জনপদে উন্নয়নের আলো ছড়িয়ে পড়েছে।’

প্রকল্পের কর্মীদের তথ্যপ্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা নিউজবাংলাকে জানান, ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি নকশা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরুর সময়ই ৫০০ কর্মী ছিলেন। এরপর কাজের সঙ্গে বাড়তে থাকে কর্মী। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের সময় ১২০০ থেকে ২০০০ কর্মী ছিলেন।

২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ২০ হাজার কর্মী কাজ করেছেন। এরপর কাজের চাপ কমে যাওয়ায় কর্মীর সংখ্যাও কমতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাসে সাড়ে ৪ হাজার কর্মী কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার জনই বাংলাদেশি। বাকি ৫০০ কর্মী ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের ২২টি দেশের নাগরিক।

দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, কলম্বিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নেপাল এবং আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া। বিদেশি কর্মী-কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে চীনের।

বিদেশিদের মাসিক বেতন সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৮০ হাজার। বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে শ্রমিক থেকে ফোরম্যান পর্যন্ত বেতন ছিল ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত।

দেশি-বিদেশি উপকরণপদ্মা সেতুর পিলার ও স্ল্যাব তৈরির জন্য স্টোন চিপ আনা হয়েছে দুবাই ও ভারত থেকে। যে রড, সিমেন্ট, বালু লেগেছে তার সবই দেশি। প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, সেতু তৈরির প্রধান প্রধান উপকরণের মধ্যে বাংলাদেশের এমএস রড, বালু ও সিমেন্টই ব্যবহার হয়েছে। অন্যান্য প্রধান সব উপকরণই বিদেশ থেকে আনা হয়।

৬ থেকে ৩৮ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে চলবে নৌযানমূল সেতুর ৬ নম্বর থেকে ৩৮ নম্বর পিলারগুলোর যেকোনো ফাঁকা জায়গা দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে। এর প্রত্যেকটি পিলারের পাইল ক্যাপ থেকে সেতু পর্যন্ত উচ্চতা ১৮ দশমিক ৩ মিটার। দুই পিলারের মাঝের দূরত্ব ১৩১ মিটার। বর্ষা মৌসুমে পানির স্তর পাইল ক্যাপের নিচেই থাকে। আর ১৮ দশমিক ৩ মিটার উচ্চতার বেশি কোনো নৌযান নেই বাংলাদেশে।

প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ২০০৭ সালের আগস্টে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

পদ্মায় মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৫ সালে ৭ নম্বর পিলার বসানোর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুর কাজ আরও আগেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারি ও প্রবল বন্যায় কাজের ব্যাঘাত হওয়ায় দুই বছর বাড়ে প্রকল্পের মেয়াদ।

অর্থনৈতিক প্রভাবসেতুটির মাধ্যমে দক্ষিণের ১৯ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। এর ফলে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা বন্দরটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে বেনাপোল স্থলবন্দরেরও।

এসব যোগাযোগের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়ার যে আশা করা হচ্ছে সে প্রসঙ্গে কথা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সম্ভাব্যতার বড় জায়গাটায় না গেলাম, সর্বনিম্ন সমীক্ষাটিও যদি গ্রহণ করি, তাহলেও দক্ষিণ বাংলার যে ২১ জেলা আছে সেখানে ২ শতাংশ জিডিপি বাড়বে। আর পুরো দেশের জিডিপি কম করে হলেও ১ শতাংশ বাড়বে, এর বেশিও বাড়তে পারে।’

রেলসংযোগ প্রকল্পে ইলেকট্রিক ট্রেনপদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে যান চলাচল ও ট্রেনের লাইন হচ্ছে। দুই পারের সঙ্গে রেলসংযোগ করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প (পিবিআরএলপি)।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বৃহত্তম এই প্রকল্পের অধীনে রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেললাইন হচ্ছে। প্রকল্পটির সবশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ কোটি ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের সময় দুই বছর বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীন সরকারের ঋণের অর্থে এই প্রকল্প জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। প্রকল্পে ঢাকার মেট্রোরেলের মতো ইলেকট্রিক ট্রেনের প্রযুক্তি থাকবে।

এই রেললাইনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে জাতীয় ও আন্তদেশীয় রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। রেলপথটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় প্রথম রেলসংযোগ স্থাপন করবে।

এ বিভাগের আরো খবর