বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অমিত এক সাহসের গর্বিত রূপান্তর

  •    
  • ২৪ জুন, ২০২২ ০৮:৫৮

২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উচ্চারণেই বদলে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সব অনিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা আজ সত্যি হয়েছে, প্রমত্ত পদ্মাকে জয় করে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের অহংকারের সেতু।

‘পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।’

২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সাহসী উচ্চারণেই বদলে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সব অনিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা আজ সত্যি হয়েছে, প্রমত্ত পদ্মাকে জয় করে দুই প্রান্ত এক করে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের অহংকারের সেতু।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদর্পে উচ্চারণ করেছিলেন, 'দাবায় রাখতে পারবা না’। তার এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল।

পিতার সেই ‘দাবায় রাখতে পারবা না’ সাহসী ভাষণের ৫১ বছর পর তার মেয়ে শেখ হাসিনা ‘পদ্মা সেতু আমরা করবই’ ঘোষণার সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।

১০ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই ঘোষণা দেশের মানুষের মধ্যে কতটা সাড়া ফেলেছিল, আলোড়ন তুলেছি তার প্রমাণ পাওয়া যায় সারা দেশে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে থাকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মেলে সহায়তার। যে যার অবস্থান থেকে সহায়তার ঘোষণা দিতে থাকেন।

প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার চার দিন পর ৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় বলা হয়, এ প্রকল্পে অর্থায়ন করা বা ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সরকার বিশ্বব্যাংককে আর অনুরোধ করবে না। যত দ্রুত সম্ভব সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

পদ্মা সেতু থেকে যেভাবে বিদায় বিশ্বব্যাংকের২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল- সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে মহাজোট সরকার। দেশের দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে সড়কপথে সরাসরি ঢাকায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ‘দুর্নীতি চেষ্টার’ জটিলতার আবর্তে মহাজোট সরকারের চার বছরেও শুরু করা সম্ভব হয় না সেতুর কাজ।

২০১১ সালে সাড়ম্বরে বিশ্বব্যাংকসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে একে একে চুক্তি করে ওই মেয়াদেই সেতুর কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের ১৫.২ অনুচ্ছেদে ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি।

তবে ২০১১ সালের শেষ ভাগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে আটকে যায় প্রকল্প। এরপর একে একে ঘটে যায় অনেক ঘটনা।

সরকার দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের পর তাদের ফেরাতে শুরু হয় নানা তৎপরতা। বিশ্বব্যাংকের কথামতো পদত্যাগ করেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, ছুটিতে যান প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমান, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

এরপর বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলালেও শর্ত দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের ভিত্তিতে মামলা করার। সেই মামলাও হয়। তারপরও কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি বিশ্বব্যাংক।

পদ্মার ওপর সেতু নিয়ে আলোচনা শুরু হয় অনেক আগেই। সেতুটি মাওয়ায়, নাকি পাটুরিয়ায় হবে- তা নিয়েও অঞ্চলবাসীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

এরপর সেতুর বিষয়টি অনেক দিন চাপা থাকলেও ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কয়েক দফায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ডলার। সিদ্ধান্ত হয়, সড়ক ও রেল উভয় যান পারাপার হবে এই সেতুতে; ওপরে চলবে গাড়ি, নিচে চলবে ট্রেন।

২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি সেতুর তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের দরপত্রের প্রস্তাব অনুমোদন করে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মূল্যায়ন কমিটি, এই কমিটি পরে কয়েক দফা বদলায়, এর পরেই ওঠে ‘দুর্নীতিচেষ্টার’ অভিযোগ।

কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি।

মোট নির্মাণ ব্যয় ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকল্পের ‘লিড ডোনার’ হয় বিশ্বব্যাংক। এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকা ৪১ কোটি ৫০ লাখ, আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ দেয়ার কথা সরকারের।

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আসা সংস্থাটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বপ্নে অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।’

দুর্নীতিমুক্তভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরেও জোর দেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত তাকে আশ্বস্ত করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে এই সেতু নির্মাণ করা হবে।

তখন অর্থমন্ত্রীর পাশে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, পরে যাকে সমালোচনার মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়।

২০১১ সালের অক্টোবরের মধ্যে সেতু নির্মাণকাজের ঠিকাদার নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে মুহিত বলেছিলেন, ‘সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের স্বপ্নের অনেকটাই বাস্তবায়ন হবে এই সেতু নির্মাণ হলে।’

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে মোট দেশজ উৎপাদন ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে এবং প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমবে।

তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ফিকে হতে থাকে এইসব স্বপ্ন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার প্রথম খবরটি পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ সাধার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

বিশ্বব্যাংক তখন জানায়, তারা নিজেরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

পদ্মা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের।

বিশ্বব্যাংকের মুখপাত্র লেসলি কুইন্টনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ।

রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলাতেও আসামি করা হয় এই দুজনকে।

ওই বছরের ১০ অক্টোবর পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের ওই সময়ের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানান, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবেন না।

বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। তবে প্রকল্পের কাজ বন্ধই থেকেছে।এই নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্বব্যাংক।

চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্বব্যাংক যুক্তি দেখিয়েছে, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।‘দুর্নীতির’ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।’

পদ্মা প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ তথ্য প্রমাণ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে দেয়া হয় বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন এর মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানায়, মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি। তবে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে।

নিজের অর্থায়নে সেতুর ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীরবিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে। পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১২ সালের ৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।

তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।’

বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা একটি পয়সাও ছাড় করেনি, তারা দুর্নীতির অভিযোগ করে। তাদের ভেতর যে দুর্নীতি তা দেখেন।’

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে জটিলতার মধ্যে মালয়েশিয়ার সঙ্গে পদ্মা সেতু তৈরির আলোচনা এগিয়ে নিয়েছিল সরকার। তবে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে ফেরার পর তা আর এগোয়নি।

দুদকের মামলার পর বিশ্বব্যাংকের সবশেষ অবস্থান না জানার মধ্যে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি আকস্মিকভাবেই তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীকে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়ন করতে বলেন।

বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে পদত্যাগ-ছুটিনিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এলেও বিশ্বব্যাংককে ফেরানোর চেষ্টাও চলতে থাকে। এ জন্য তাদের দেয়া শর্তগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

আর এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই পদত্যাগ করেন আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০১১ সালেই তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

এরপর তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়ান। তবে তিনি বারবার বলেছিলেন, তার কোনো দোষ ছিল না।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থাটি আবুল হোসেনের অপসারণ চাচ্ছিল। তার আগে উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি তারবার্তায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আবুল হোসেনের সততা নিয়ে সন্দেহ করছেন।

বিশ্বব্যাংক যে চারটি শর্ত দেয়, তার চতুর্থটি ছিল তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তি অর্থাৎ আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের ছুটি দেয়া।

সে সময় অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ডস্টেইনের (অ্যালেন) দেয়া চারটি প্রস্তাবের মধ্যে চতুর্থটি মেনে নেয়ায় একটু অসুবিধা ছিল। আমরা চেষ্টা করছি, এটাও কীভাবে সমাধান করা যায়।’

এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন। ‘যাব না’ করেও ছুটিতে যান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

মসিউর ছুটিতে যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা প্রকল্পে ফেরার ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে সরকার প্রকল্পে অর্থায়নকারী অন্য সংস্থাগুলোর শরণও নিয়েছিল।

মামলা হলো, তারপরও ফিরল না বিশ্বব্যাংকবিশ্বব্যাংক ফেরার সময় ‘দুর্নীতি’তে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়েছিল। আর দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত পর্যবেক্ষণের অনুমতিও নিয়েছিল।

তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, মামলা না হলে ঋণ মিলবে না।অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘দুদককে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সেতুকে বাস্তবে পরিণত করার বিষয়টি এখন দুদকের হাতে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির অভিযোগের সারবত্তা না পাওয়ার দাবি করলেও এরপর ১৭ ডিসেম্বর মামলা করে।

দুর্নীতি দমন কমিশন জানায়, ঘুষ লেনদেন না হলেও তার একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং তাতে সাত ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ তারা পেয়েছে।

মামলার প্রধান আসামি করা হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেনকে। বাকি ছয় আসামি হলেন, সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদীশাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এই মামলায় ওই দুজনকে আসামি করা হয়নি।

আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে আসামি না করার বিষয়ে দুদক জানায়, ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রে তাদের ভূমিকার বিষয়ে অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা যায়নি।

দুদকের মামলার পর জটিলতার অবসান ঘটেছে বলে অর্থমন্ত্রী মুহিত বললেও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত পর্যবেক্ষণে সংস্থাটি লুইস গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে যে প্যানেল করেছে, সেই প্যানেল ঢাকা থেকে ফিরে যাওয়ার পর এই মামলা হয়। তবে মামলার আসামি কাদের করা হবে, তা নিয়ে মতভেদ নিয়েই তিন সদস্যের ওই প্যানেল ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকা ছাড়ে।

মামলার পর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ১৭ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানান, ওকাম্পো নেতৃত্বাধীন প্যানেল মামলার এজহার পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর প্রতিবেদন দেবে। ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে, তারা পদ্মা প্রকল্পে থাকবে, না কি থাকবে না।

বিশ্বব্যাংককে সরকারের ‘না’২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সবশেষ অবস্থান নিয়ে একটি বিবৃতি দেয় সরকার। সে সময়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খানের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাংকের আজকের তারিখে (১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, তারা পদ্মা সেতুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা আর চাইছে না এবং পদ্মা সেতুর তদন্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।

‘বাংলাদেশ সরকার কিছুদিন আগে থেকেই বলছে যে, তারা জানুয়ারি ২০১৩-এর মধ্যে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাবর্তন আশা করছিল এবং জানুয়ারিতেই এই বিষয়ক বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার গতকাল বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে, তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এক্ষুণি শুরু করতে চাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই কাজটি শুরু করতে হচ্ছে।

‘বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা ছিল বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক এবং সরকার প্রথম থেকেই যা বলছে তা তারই প্রত্যয়ন। সরকার প্রথম থেকেই বলছে যে, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিষয়ক অভিযোগ তারা যথাযথভাবেই বিবেচনা করছে। কিন্তু অভিযোগের পক্ষে প্রমাণের অভাবে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত এফআইআর পেশ করার মতো অবস্থা ছিল না।‘

বিবৃতিতে আরাস্তু খান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক পরবর্তীকালে নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত প্রমাণ সরবরাহ করলে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর পেশ করে। এই এফআইআরে তারা আরও কতিপয় অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্বন্ধে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানায়। বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে এই পদক্ষেপটি যথাযথ এবং তারই ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করা সমীচীন হতো। এ ক্ষেত্রে দেখা গেল যে বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি বিশ্বব্যাংকের সময়সূচির সঙ্গে সমঞ্জস্য নয়। বিশ্বব্যাংকের সময়সূচি অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ অনিশ্চিত।

‘নির্বাচনি অঙ্গীকার পরিপূরণের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য শুধু সড়ক সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হবে। গতকাল বিশ্বব্যাংককে সরকার এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। একই সঙ্গে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদেরও এই তথ্য সরবরাহ করে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সূচি এবং পদক্ষেপ নিয়ে সকল উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সত্বর তাদের ঢাকায় আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’

বিবৃতির শেষে বলা হয়, ‘অর্থমন্ত্রী ভেবেছিলেন যে আগামী রোববার অথবা সোমবারে তিনি এ বিষয়ে সংসদে বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা সেতু বিষয়ে আজকের বিজ্ঞপ্তিটি দেয়া হলো। আগামী রোববার বা সোমবার অর্থমন্ত্রী এই বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিস্তৃত বক্তব্য রাখবেন।’

এ বিভাগের আরো খবর