এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলমান বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে কত ধরনের ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণেই ব্যবহার করা হয়েছে নানা সক্ষমতার ক্রেন।
তবে একটি বিশেষ ক্রেনকে ঘিরে মানুষের ছিল বাড়তি আগ্রহ, সংবাদপত্রে শিরোনামও হয়েছে বারবার। প্রতিটি স্প্যান পিলারে বসানোর সময় আলোচনায় এসেছে ক্রেনটি।
আলোচিত ক্রেনটির নাম তিয়ান-ই। মূল সেতুর স্প্যানকে নদীর পাড় থেকে পিলারে নিয়ে বসাতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ধরনের এই ভাসমান ক্রেন। পাঁচ হাজার টন ক্ষমতার ক্রেনটি দেখতেও পদ্মায় গেছেন হাজারও মানুষ।
সেতুর মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে ইস্পাতের স্প্যান দিয়ে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার।
ধূসর রঙা আয়তাকার স্প্যানগুলো দেখতে অনেকটা খাঁচার মতো। স্প্যানের ওপরে তৈরি করা হয়েছে সড়কপথ। আর ভেতরে বসছে রেললাইন। পদ্মার দুই প্রান্ত যুক্ত করতে এমন স্প্যান লেগেছে ৪১টি।
স্প্যানগুলো তৈরি হয়েছে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের শিংহুয়াংডাও শহরের একটি কারখানায়। চীন থেকে প্রতিটি স্প্যান বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে আনতে সময় লেগেছে ২১ থেকে ৩০ দিন।
সেখানে থেকে ছোট ছোট জাহাজে সেগুলো আনা হয় মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায়। তারপরের ঠিকানা মাওয়া প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে।
সেখানে একেকটি অংশ জোড়া দিয়ে ১৫০ মিটার লম্বা স্প্যান তৈরি করা হয়। ওয়ার্কশপে চূড়ান্ত ওয়েল্ডিং শেষে ধূসর রং দেয়া হয় স্প্যানে। সব শেষে প্রতিটি স্প্যানের ওজন হয় ৩ হাজার ২০০ টন।
এই বিপুল ওজনের স্প্যান পদ্মার বুকে নিয়ে পিলারে বসানোর কাজটি সহজ ছিল না। এ জন্য চীন থেকে নিয়ে আসা হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিসম্পন্ন ভাসান ক্রেন ‘তিয়ান-ই’-কে। এটির মালিক পদ্মা সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে সর্বাধুনিক এই ক্রেনটি প্রায় চার বছর ব্যবহার করেছে বাংলাদেশ। স্প্যান বসানোর কাজ শেষে তিয়ান-ই ফেরত গেছে নিজ দেশ চীনে।
ক্রেনটি ব্যবহারে প্রতি মাসে গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ক্রেনটির ব্যবহারে ৪৫ মাসে খরচ হয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা।
তিয়ান-ই-এর সক্ষমতা নিয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি পাঁচ হাজার টন ক্যাপাসিটির।’
এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল বলেন, ‘এটি পৃথিবীর অন্যতম বড় ক্রেন, সবচেয়ে বড় কি না জানা নেই। আমাদের প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন, তাই এর চেয়ে বেশি ক্যাপাসিটির ক্রেন ব্যবহার করা হয়েছে।’
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের জানান, ভাসমান ক্রেনটির দাম আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ক্রেনটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে আনা হয়। সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান থেকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুর ৪২টি পিলারে ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ করে ক্রেনটি।
১৩ ডিসেম্বর চীনের উদ্দেশে রওনা দেয়া ক্রেনটি বাংলাদেশ থেকে প্রথমে নেয়া হয় হংকংয়ে। মাওয়া থেকে চট্টগ্রাম নিতে ক্রেনটির নিরাপত্তায় ছিল পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী।
চট্টগ্রাম থেকে একটি মাদার ভেসেলযোগে হংকংয়ে যায় ক্রেনটি। ২০১৭ সালে মাওয়া আসা তিয়ান-ই ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি স্থাপন করে। এর মধ্য দিয়ে পদ্মায় দৃশ্যমান হয় সেতুর একটি অংশ।
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটিতে ৪১তম স্প্যান বসিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীকে যুক্ত করে তিয়ান-ই। আর এর মধ্য দিয়ে ক্রেনটির মিশন শেষ হয় বাংলাদেশে।