বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বদলে গেছে পদ্মা সেতুতে জমি হারানোদের জীবনও

  •    
  • ২৩ জুন, ২০২২ ২৩:৪৬

পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো হলো মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ও যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্র, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন ও পশ্চিম নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং মাদারীপুরের শিবচরের বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্র।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের সবাইকেই জমি ও অবকাঠামোর ক্ষতিপূরণ বাবদ কয়েক গুণ টাকা দিয়েছে সরকার। আর স্বপ্নের এই সেতুর জন্য যারা বাপ-দাদার ভিটেমাটি পুরোটাই হারিয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণের টাকার পাশাপাশি বসবাসের জন্য প্লটও করে দিয়েছে সরকার। পাঁচটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নামমাত্র মূল্যে আড়াই, পাঁচ ও সাত শতাংশের প্লট দেয়া হয়েছে তাদের। প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সবুজে ঘেরা নান্দনিক এসব পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

সেখানে বসবাসরতরা কেমন আছেন তা জানতে নিউজবাংলা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছে, কথা বলেছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।

পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো হলো মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ও যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্র, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন ও পশ্চিম নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং মাদারীপুরের শিবচরের বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্র।

মুন্সীগঞ্জের দুই কেন্দ্র

লৌহজং উপজেলার মাওয়া চৌরাস্তাসংলগ্ন কুমারভোগ ও যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৭৮০টি প্লট রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা জীবনযাপন করছেন গ্রাম্য পরিবেশে শহুরে প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। নানা রকম ফলদ ও ঔষধি গাছের পাশাপাশি ফুলগাছ রয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রের রাস্তার পাশ দিয়ে।

কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রবেশমুখেই রয়েছে মসজিদ। ভেতরে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠাগার, খেলার মাঠ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পানির ট্যাংকি ও কবরস্থান। স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ সুবিধাসহ প্রতিটি প্লটের সঙ্গেই রয়েছে পিচঢালাই রাস্তা।

বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণে জমি, ঘর ও গাছপালা বাবদ যথাসময়েই টাকা পেয়েছেন তারা। যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪৫১টি প্লট রয়েছে, কুমারভোগে রয়েছে ৩৩৯টি। এগুলোর মধ্যে কিছু আড়াই শতাংশের প্লট, কিছু পাঁচ শতাংশের এবং বাকিগুলো সাত শতাংশের প্লট।

যশোলদিয়া কেন্দ্র

যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্লট পাওয়া মায়া বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার হাজব্যান্ড আব্দুল করিম পাঁচ শতকের প্লট পান আট বছর আগে। তিনি মারা গেছেন। এখানে পানি, বিদ্যুৎ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট সবই ভালো। কিন্তু বহিরাগতদের অত্যাচার রয়েছে। বাইরের ছেলেরা, স্থানীয় ছেলেপেলেরা এসে আমাদের গালাগালি করে, উঠিয়ে দেবে বলে হুমকি-ধমকি দেয়।’

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইমন জানালেন, মাঝেমধ্যেই পানির লাইন নষ্ট হয়ে যায়। নিজেরা টাকা তুলে তা ঠিক করেন। এ ছাড়া এখানে তেমন কোনো অসুবিধা নেই।

যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে আড়াই শতাংশের প্লটে ঘর তুলে সপরিবারে বসবাস করছেন মো. আরমান। তিনি জানান, প্রথম থেকেই এখানে আছেন তারা। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন।

যশোলদিয়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে কথা হয় কেন্দ্রের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাওয়া চৌরাস্তা এলাকায় আমার ২২ শতক জায়গা ছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ওই জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছে। আমি আড়াই শতকের একটি প্লট পেয়েছি। আমার ভাইয়েরাও পেয়েছে। এখানে আধুনিক অনেক সুযোগ-সুবিধাই আছে। তবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও বেশির ভাগ সময় পর্যাপ্ত সুবিধা পাওয়া যায় না।’

আগে কেমন ছিলেন, এখন কেমন আছেন- জানতে চাইলে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘মাওয়া চৌরাস্তায় আগে আমাদের ব্যবসা ছিল, আয়-রোজগার ছিল ভালোই। এখন দোকান না থাকায় রানিং আয়টা কমে গেছে। তবে সব মিলিয়ে আমরা ভালোই আছি।’

প্লট পাওয়া অনেকেই ঘরবাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

কুমারভোগ কেন্দ্র

কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের পাঁচ শতাংশের প্লটে বসবাস করছেন মো. মনির হোসেন। তিনি জানান, তার সাড়ে ১৩ শতাংশ জায়গা ছিল। সেই জমি পদ্মা সেতুর জন্য সরকার নিয়েছে। টাকা দিয়েছে ৩৪ লাখ।

কেমন আছেন জানতে চাইলে মনির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক কথায় ভালো আছি। পানি, বিদ্যুৎসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই আছে এখানে। পদ্মা সেতু দিয়ে গ্যাসের সংযোগ যাচ্ছে, সেখান থেকে সংযোগ পেলে আমরা আরও ভালো থাকব।’

এই কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশের প্লট পেয়েছেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রাথমিক স্কুল থাকলেও মাধ্যমিক স্কুল নেই। একটা মাধ্যমিক স্কুল হলে ছেলেমেয়েদের দূরে যাওয়া লাগত না।’

কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রের সভাপতি আলতাফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধাই আছে। দুই হাজারের বেশি মানুষ থাকে। তবে গোরস্থান ও খেলার মাঠ নেই। ময়লা ফেলানোরও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। অনেকেই যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলায় দুর্গন্ধ ছড়ায়।’

এই কেন্দ্রেও অনেকে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

মুন্সীগঞ্জের এই দুই পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজ্জব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে কোনো সমস্যার কথা আসে না। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা ভালো আছেন। তারা যা চেয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব দেয়া হয়েছে। কবরস্থান, খেলার মাঠের চাহিদার কথা বলা হচ্ছে, সেসব দেয়ার মতো ফান্ড এখন নেই।’

শরীয়তপুরের দুই কেন্দ্র

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংযোগ সড়ক, নদীশাসন, সার্ভিস এরিয়া-২ ও সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডের জন্য সেতুর জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এতে অনেকেই বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারান।

ভূমিহীন এসব পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার জন্য পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন ও পশ্চিম নাওডোবা ইউনিয়নে পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, যেখানে ১ হাজার ১৬৪টি পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে পূর্ব নাওডোবায় থাকে ৬৫০টি পরিবার আর পশ্চিম নাওডোবায় ৫১৪টি। পশ্চিম নাওডোবা কেন্দ্রে প্রায় সব ধরনের নাগরিক সুবিধাই নিশ্চিত করা হয়েছে। পূর্ব নাওডোবার অবকাঠামো নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি।

পশ্চিম নাওডোবা কেন্দ্র

এই কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পাকা রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি। এখানকার বাসিন্দাদের একজন রাজিয়া বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ বছর ধইরা এইহানে থাহি। আমার সাড়ে আট শতাংশ জমি গ্যাছে পদ্মা সেতুর কামে। জমির টাহাও পাইছি। আবার এইহানে আইয়্যা পাঁচ শতক জমিও পাইছি। ঘরের লগে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ওষুধ সবই আছে। টাউনের মতোই লাগে।’

রাজিয়া বেগমের মতো এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশের প্লট পেয়েছেন শাহজাহান হাওলাদার।

নিউজবাংলাকে তিনি জানান, তার ২৫ শতাংশের বাড়িসহ দুই বিঘা জমি। সেতুর জন্য সবই নিয়েছে সরকার, দিয়েছে ক্ষতিপূরণের টাকাও। পুনর্বাসন কেন্দ্রে আধাপাকা ঘর তুলে পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি।

কেমন আছেন- জানতে চাইলে শাহজাহান হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক জায়গাই সবকিছু আছে। শান্তিতেই আছি। আমার ছেলেডা এইহান তোন গাড়ি চালানোর টেনিং লইতাছে। এরপর বড় গাড়ি চালাইব। অহন আর দুশ্চিন্তা নাই।’

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের নাওডোবা পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলটি হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। সাতজন শিক্ষক ও পাঁচজন স্টাফের কর্মসংস্থানও হয়েছে। শিক্ষার সহায়ক পরিবেশ ও উপকরণ সবই এখানে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য বিশাল মাঠও আছে।’

পূর্ব নাওডোবা কেন্দ্র

সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড-ঘেঁষা পূর্ব নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৬৫০ পরিবারের বসবাস।

পুনর্বাসন প্রকল্প কমিটির সভাপতি লতিফ ফকির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাগো এইড্যা তো পোথ্যোম অধিগ্রহণ কইরা নেয় নাই। এই জন্যই পোথ্যোম থিক্যা কাজ শুরু হয় নাই। পরে যখন অধিগ্রহণ করল, ওইয়ার পর থিকাই আমাগো পারমান্যান্ট করছে। এই জন্যই উন্নয়নকাজ দেরি অইছে। অহন সবকিছুই দ্রুত চলতাছে। আমরা ২৫ সদস্যের কমিটি এখানকার সবকিছু ভালো-মন্দ দেহি। পরিবারগুলোর সুবিধা-অসুবিধা আমরা সেতু কর্তৃপক্ষকে জানাই।’

মাদারীপুরে একটি কেন্দ্র

মাদারীপুরের শিবচরের বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্লট রয়েছে ৬১১টি। এখানে বসবাসে ‘কিছুটা সমস্যা’য় পড়লেও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য জমি দিয়ে খুশি বাসিন্দারা।

কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশের প্লট পেয়েছেন আব্দুর ছাত্তার মাতুব্বর। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে পদ্মা সেতুর বেড়িবাঁধের জন্য আমার ৯৮ শতাংশ জমি ও ১৬ শতাংশ বাড়ির জায়গা নিয়েছে সরকার। এ জন্য টাকাও দিয়েছে। পরে বাখরেরকান্দি এলাকায় পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশ জমি পাই ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। এই জায়গায় আমার চার ছেলে ও তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করছি।’

এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে সম্প্রতি ঘর তুলেছেন শাহজাহান খান।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আড়াই শতাংশ জায়গা পাইছি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকা লাগবে। এতদিন কাগজপত্রে ঝামেলা থাকায় ঘর করা হয়নি। তাই এখন কোনো রকমে টিনের ঘরটা করলাম। এখানে পাকা রাস্তা আর বিদ্যুতের লাইন আছে। ড্রেনও আছে, তবে পরিষ্কার করা হয় না। আমরা চাঁদা তুলে মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করি।’

পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) হিসাবে, এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আড়াই শতাংশের প্লটের জন্য ৫০ হাজার টাকা, পাঁচ শতাংশের প্লটের জন্য ১ লাখ টাকা এবং সাড়ে সাত শতাংশের প্লটের জন্য দেড় লাখ টাকা লেগেছে। প্লট রয়েছে ৬১১টি। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬০৩টি।

বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বে রয়েছেন পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সারফুল ইসলাম সরকার।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রে জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ওখানে রাস্তা-সুপেয় পানির ব্যবস্থা আছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে দিয়েছি। এসব রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বসবাসকারীদের। আমরা তাদের সব করে দেব, এমনটা নয়।’

এ বিভাগের আরো খবর