বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ক্ষণে উচ্ছ্বসিত নদীর দুই পারের মানুষ। তবে ফেরি ও লঞ্চঘাটের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সামনে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সদা ব্যস্ত লঞ্চ ও ফেরিঘাট ২৬ জুন ভোর থেকে হয়ে যাবে নিষ্প্রাণ। আর তা ভেবে বেদনার্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১ জেলার যাত্রীদের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌরুট শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাট। এর মধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় বাংলাবাজার ঘাটের অবস্থান। এ ঘাট দিয়ে দক্ষিণের জেলার লোকজন যাতায়াত করেন।
এই ঘাটের সঙ্গে জড়িত আছেন দুই শতাধিক হকার। সারা দিন তারা ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ।
পাশাপাশি ঘাট এলাকায় খাবার হোটেল, মুদি দোকান, পান-বিড়ির দোকান, কলা-রুটির দোকান মিলে তিন শতাধিক ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরাও চিন্তায় ভুগছেন।
বাংলাবাজার ঘাটের একাধিক খাবার হোটেলের ব্যবসায়ী জানান, ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর তাদের ব্যবসায় ধস নামবে। এরই মধ্যে ঘাট এলাকার দোকানপাট সরিয়ে নিতে বলেছে প্রশাসন।
বাংলাবাজার ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে দেড় শতাধিক খাবারের হোটেল রয়েছে। ২৪ ঘণ্টাই কোনো না কোনো খাবার হোটেল খোলা থাকে। হোটেল ব্যবসার সঙ্গে মালিকসহ দিনভিত্তিক মজুরির অনেক কর্মীও জড়িত। সেতু চালু হলে এসব হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
বাংলাবাজার ঘাটের সুগন্ধা হোটেলের মালিক আনোয়ার ব্যাপারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে কাওড়াকান্দি, কাঁঠালবাড়ী ও বাংলাবাজার ঘাটে হোটেলের ব্যবসা করেছি। কিন্তু এখন আর পারব না। সেতু চালু হলে কোনো লোকজন এখানে আসবে না। তাই আগেভাগেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছি।
‘কর্মচারীরাও ঢাকায় ব্যবসা খুঁজছে। আমি পাচ্চর এলাকায় মুদি দোকান দেব। সবাই কোনো না কোনো পেশায় চলে যাচ্ছে। সেতু হচ্ছে এতে আমরা আনন্দিত, তবে এতে আমাদের দীর্ঘদিনের ব্যবসাও শেষ হয়ে গেল।’
হোটেল ব্যবসায়ী খবির ফকির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘাটে আমরা প্রায় এক হাজার মালিক-কর্মচারী ছিলাম। কেউ হকারি, কেউ ফলের ব্যবসা, কেউ খাবার হোটেল আবার কেউ ডাব-পানি বেঁচেও জীবিকা নির্বাহ করত। তবে সেতু চালুর পরে একটা মানুষও এদিকে মুখ তুলে তাকাবে না। তাই আমরা সবাইকে অন্য পেশায় যেতে অনুরোধ করেছি।’
পদ্মাপারের অনেকে ঘাটে হকারের কাজ করতেন। তাদের মধ্যে মুখরোচক খাবার বিক্রেতার সংখ্যাই কমপক্ষে ২০০ জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, কেউবা রাত অবধি নৌযানে ঘুরে ঘুরে নানান খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এই নৌরুটে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিডবোট, ২৭টি ফেরি বর্তমানে চলছে।
পানি বিক্রেতা আফজার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে ঘাটে ডাব-পানি বিক্রি করি। এখন ভাবছি এলাকায় একটা ছোট দোকান দেব। সেখানে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালাব। ঘাটের ব্যবসা বন্ধ হলে তো আর মরে যাব না, একভাবে চলবই।’
বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবসায়ী নেতা মনোয়ার ব্যাপারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই বিকল্প পেশা নিয়ে সবাই চিন্তাভাবনা করেছে। অনেকে বাড়ির কাছাকাছি ছোট দোকানও দিয়েছে। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে অনেকে অন্য ব্যবসায় যাবে। কেউ কেউ কৃষিকাজে নিয়মিত হবে। পাশাপাশি পদ্মায় মাছ শিকার তো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘সেতু ঘিরে পদ্মাপারে একাধিক গ্রামীণ বাজারসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। নদীশাসন বাঁধসহ সেতু এলাকায় অনেক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। বিকেলের দিকে অসংখ্য মানুষ ঘুরতে আসছেন। সে ক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু না কিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
শিবচর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বি এম আহাতার ব্যাপারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘাটে অনেক রকমের ব্যবসায়ী আছেন। তাদের সাময়িক কিছুটা সমস্যা হবে। তবে বিকল্প পেশায় তারা ইতোমধ্যে চলে গেছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে।’