চাকরিতে দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি মো. আবুল হাসেম খানের বিরুদ্ধে।
এসব সম্পদের খোঁজ পেয়ে চলতি বছর দুর্নীতি দমন কমিশন আবুল হাসেম খান ও তার স্ত্রী মাহফিজা বেগম চম্পার নামে মামলা করে। পরে মাহফিজা বেগম চম্পার নামে আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় দুদক।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আল-আমিন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কার্যালয়ে ওসি হাসেম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছিল। তার মধ্যে ওসি হাসেমের বিরুদ্ধে মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে।’
মামলা ও অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওসি হাসেম ৩৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৯৯ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য গোপন করেছেন এবং তার আয়ের সঙ্গে ৩২ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ টাকার সম্পদের অসংগতি রয়েছে।
এ ছাড়া তার স্ত্রী ৯ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ১৯৮ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য গোপন করেছেন এবং তার আয়ের সঙ্গে ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৬৮ টাকার সম্পদের অসংগতি রয়েছে।
সূত্র জানায়, মো. আবুল হাসেম খান ১৯৭৭ সালে এসএসসি পাস করে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে উপপরিদর্শক ও ১৯৯৭ সালে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। দেশের বিভিন্ন থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অফিসার ইনচার্জ থাকা অবস্থায় তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান। তার স্ত্রী মাহফিজা বেগম চম্পা একজন গৃহিণী। ব্যক্তিগত জীবনে তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
মো. আবুল হাসেম খান ও তার স্ত্রী- দুইজনেরই পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলায়। তবে যশোর, খুলনা ও ঢাকায় তাদের পৃথক হোল্ডিং রয়েছে। বর্তমানে তারা যশোর পৌরসভার পূর্ব বারান্দি এলাকায় নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করছেন।
ওসি হাসেমের বিরুদ্ধে মামলা
চলতি বছরের ১২ মে দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মোশারেফ হোসেন বাদী হয়ে আবুল হাসেম খানের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, যশোর শহরের বারান্দি মৌজায় ওসি হাসেমের নামে ১০ শতক জমি, মনিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর মৌজায় সাড়ে ৭ শতক জমি, যশোর সদর উপজেলায় কচুয়া মৌজায় ৫ দশমিক ৪০ একর জমি রেকর্ড রয়েছে। এসব জমির অনেকাংশ তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়ার কথা বললেও কোনো দলিল দেখাতে পারেননি।
এ ছাড়া ওসি হাসেম ও তার স্ত্রীর যৌথ নামে যশোর শহরের বারান্দি মৌজায় ২৭ শতক জমির ওপর চার তলা বাড়ি ও একটি নির্মাণাধীন বাড়ি রয়েছে। মনিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর মৌজায় তাদের দুইজনের নামে ২৮ দশমিক ১২ শতক জমিতে একটি একতলা পাকা বাড়ি ও সেমি পাকা তিনটি বাড়ি রয়েছে।
মামলায় আরও অভিযোগ, ওসি হাসেম দুদকে যে সম্পদ থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার থেকে ৩৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৯৯ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার আয়ের সঙ্গে ৩২ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ টাকার সম্পদের অসংগতি রয়েছে।
ওসির স্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট
চলতি বছরের ২০ মার্চ দুদকের সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম মোড়ল বাদী হয়ে আবুল হাসেম খানের স্ত্রী মাহফিজা বেগম চম্পার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
পরে ১২ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম মোড়ল ও সহকারী পরিচালক মো. মোশারেফ হোসেন তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, মাহফিজা বেগম চম্পার নামে ঢাকার খিলগাঁও চৌরাস্তা ব্লকে ২ কাঠা জমি, ডেমরায় সাড়ে ৩ কাঠা ফাঁকা জমি, খুলনার নিরালায় ৯ দশমিক শূন্য ৫ কাঠা জমি, যশোর শহরের বারান্দি মৌজায় পৃথক ৯ শতক, ৮ শতক ও ৮.২৫ শতক জমি, যশোর সদরের জিরাট মৌজায় পৃথক দেড় শতক ও ২ দশমিক ২ শতক জমি, মনিরামপুরের দুর্গাপুর মৌজায় পৃথক ১০ শতক ও সাড়ে ৯ শতক জমি, মনিরামপুরের বিজয়রামপুর মৌজায় সাড়ে ৭৫ শতক জমি, ঢাকার গুলশানে রাজাবাড়ী মৌজায় ৭ দশমিক ১৬ শতক জমি ও যশোর সদরের কচুয়া মৌজায় ১০৪ শতক জমি রয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকার ধানমন্ডি মৌজায় নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের ১৭ তলা একটি ভবনের অষ্টম তলায় ২৫০৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় দুই ইউনিটবিশিষ্ট ৬ তলা একটি পাকা বাড়ি, খুলনার নিরালায় ৪ ইউনিটবিশিষ্ট ৯ তলা একটি পাকা বাড়ি ও যশোর শহরে একটি ৪ তলা পাকা বাড়ি রয়েছে।
এ ছাড়া মাহফিজা বেগম চম্পার নামে টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ি, ঘরে দামি আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী ও ব্যবসায়িক পুঁজি পাওয়া গেছে।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, ওসি হাসেমের স্ত্রী মাহফিজা বেগম চম্পা দুদকে যে সম্পদ থাকার ঘোষণা দিয়েছিল, তার থেকে ৯ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ১৯৮ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার আয়ের সঙ্গে ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৬৮ টাকার সম্পদের অসংগতি রয়েছে।
ওসি হাসেম যা বলছেন
দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে আবুল হাসেম খান বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার বিরুদ্ধে দুদক মামলা দিয়ে কী করবে। আমি সারা জীবনে সাধারণ একটি চাকরি করেছি। ৫ বছর আগে অবসরে এসেছি। আমাদের তো তেমন কিছু নেই। ঋণ নিয়ে কিছু সম্পদ করেছি। এখন তা অপরাধ হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্পদ গোছাতে হলে, হয়তো ব্যাংক লুট করতে হয়, ডাকাতি করতে হয় বা চুরি করতে হয়। আমার বয়স এখন ৬৫। আমার মুখে দাড়ি আছে। আমি হজ করে এসেছি। আমি কি এসব করতে পারি?’
অভিযুক্ত সাবেক ওসির দাবি, দুদকের যশোর কার্যালয়ে শহিদুল নামে এক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে এসব করে চট্টগ্রাম চলে গেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও চাকরিজীবনে অনেক তদন্ত করেছি। দুদক আমার বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তদন্ত করেনি। সব মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করেছে।’
এ ছাড়া অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে অন্তত ১৪ বার আবেদন করেও দুদক পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি বলে জানান সাবেক ওই ওসি।