বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঢলে ভেসে যাওয়া বৃদ্ধার বাঁশে ঝুলে ১২ ঘণ্টা

  •    
  • ২২ জুন, ২০২২ ১৭:২৩

রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি ঢলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রভাতী হাজং চলে যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। এ সময় ভাগ্যক্রমে পানির ওপর ঝুলে থাকা একটি বাঁশের নাগাল পান তিনি। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই বাঁশে ঝুলে ছিলেন এই বৃদ্ধা।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন প্রভাতী হাজং। আর গভীর রাতে অকস্মাৎ বাড়ির ওপর নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। রাতের অন্ধকারে ঢলের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবাইকে। তাদের মধ্যে ৬৮ বছর বয়সী প্রভাতীকে ঢলের পানি টেনে নিয়ে যায় এক কিলোমিটার দূরে। একপর্যায়ে ঝুঁকে পড়া একটি বাঁশ ধরে টানা ১২ ঘণ্টা ঝুলে থেকে বেঁচে গেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই নারী।

নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ১৬ জুন বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটেছে। শুধু প্রভাতী নন, একইভাবে রক্ষা পেয়েছেন তার স্বামীসহ হাজং পরিবারটির আরও চার সদস্য।

রংছাতি ইউনিয়নের ধারাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রভাতী হাজং নিউজবাংলার কাছে বর্ণনা করেছেন ওই রাতের সেই দুঃসহ স্মৃতি। ঘটনাটি যেন রোমাঞ্চকর কোনো অ্যাডভেঞ্চারের গল্পকেও হার মানায়।

প্রভাতী হাজং ছাড়াও পরিবারের বেঁচে যাওয়া অন্য চারজন হলেন- তার স্বামী যোগেন্দ্র, ছেলে বিপ্লব হাজং, ছেলের বউ ঝটিকা হাজং ও দুই বছর বয়সী নাতনি শ্রদ্ধামণি হাজং। তাদের বাড়িটি ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।

নেত্রকোণায় পাহাড়ি ঢলে বিধ্বস্ত বাড়িতে দাঁড়িয়ে প্রভাতী হাজং ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা। ছবি: নিউজবাংলা

প্রভাতী হাজং জানান, বৃহস্পতিবার রাতে তারা খাওয়া-দাওয়া শেষে বসতবাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ১টার দিকে হঠাৎ ঘরদোরে পাহাড়ি ঢল আসার শব্দে জেগে ওঠেন। দেখতে পান মুহূর্তের মধ্যে ঘরে অথৈ পানি। পানির তোড়ে ঘরের বেড়া পর্যন্ত ভেঙে যাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢলের পানি মাড়িয়ে কিছুটা দূরে অবস্থিত রামনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হন।

ওদিকে বিদ্যালয়ের কাছাকাছি থাকা একটি সেতুর অ্যাপ্রোচের মাটি ঢলের তোড়ে সরে গিয়েছিল। সেখানে পা দিতেই অথৈ পানির স্রোতে ভেসে যান তারা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন একেকজন। প্রভাতীর স্বামী যোগেন্দ্র হাজং একটি বাঁশের খুঁটি ধরে এবং তার ছেলে বিপ্লব হাজং ধারাপাড়া সেতুর কাছে একটি গাছ জড়িয়ে ধরে রক্ষা পান।

আর ছেলের বউ ঝটিকা হাজং ও তার কোলে থাকা শিশু শ্রদ্ধামণি স্রোতের সঙ্গে ভেসে হাবুডুবু খেতে খেতে চলে যান বেশ দূরে অবস্থিত সোবহান মিয়ার বাড়ির কাছে। পরে তার আর্তচিৎকার শুনে সোবহান মিয়ার পরিবারের লোকজন এসে মা ও সন্তানকে উদ্ধার করেন। পাহাড়ি ঢলের পানি নাকেমুখে ঢুকে শিশুটি তখন মরণাপন্ন। পরে ওই বাড়ির লোকজন পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করেন। এতে শ্রদ্ধামণিও বেঁচে যায়।

এদিকে ঢলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রভাতী হাজং চলে যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সন্তুর ভিটার কাছে। এ সময় ভাগ্যক্রমে একটি বাঁশঝাড় থেকে পানির ওপর ঝুলে থাকা একটি বাঁশের নাগাল পান তিনি। বাঁশঝাড়টিও ছিল পানিতে নিমজ্জিত। এ অবস্থায়ই পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই বাঁশ ধরে ঝুলে ছিলেন প্রভাতী। এলাকাটি নির্জন হওয়ায় আশপাশে কোনো মানুষজনকেও দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি।

পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই এলাকার দুই কিশোর ঢলের পানির সঙ্গে ভেসে আসা লাকড়ি (গাছপালা) কুড়াতে বাঁশঝাড়ের কাছে গেলে প্রভাতী যেন কিছুটা আশার আলো দেখতে পান। তিনি ওই কিশোরদের ডেকে তাকে উদ্ধার করার আকুতি জানান। কিন্তু নির্জন স্থানে হঠাৎ কোনো নারীর করুণ আর্তি শুনে ভয় পেয়ে বাড়িতে চলে যায় কিশোররা। এরপর এক কিশোর তার বাবা নজরুল ইসলামকে ঘটনাটি জানালে তিনি নৌকাযোগে এসে প্রভাতীকে উদ্ধার করেন। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান এই বৃদ্ধা।

নিউজবাংলাকে প্রভাতী বলেন, ‘রাত দেড়টা থেকে পরদিন দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বাঁশে ঝুলে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভিজা শরীর নিয়ে ঝুলে থেকে ক্লান্ত হয়ে একসময় হাত-পা অবশ হয়ে আসে। ভেবেছিলাম আর বোধ হয় পারব না। ওদিকে আমার স্বামী, ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতনির কী অবস্থা তা-ও জানতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম পুরো পরিবারটিই বুঝি শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় আমরা সবাই বেঁচে গেছি।’

‘আদিবাসী কমিউনিটি’র নেতা চয়ন রিছিল বলেন, ‘এই ঘটনা শোনার পর অনেকেই প্রভাতীকে দেখতে তার বাড়িতে যাচ্ছেন। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে তার বসতঘরের বেড়াগুলো ভেঙে গেছে। শুধু ঘরের চাল আর খুঁটিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তিনিও বেশ অসুস্থ। এখনও ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি।’

নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলার ওই অঞ্চলটি মেঘালয় পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত। ওই এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে ঝরনা আকৃতির বেশকিছু পাহাড়ি ছড়া (নালা)। এসব ছড়া দিয়ে গেল বৃহস্পতিবার রাতে প্রবল বেগে ঢলের পানি নেমে আসে। ঘুমন্ত লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় অনেকের বাড়িঘর। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে।

এ বিভাগের আরো খবর