বন্যার সুযোগে নৌকা ভাড়া কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন মাঝিরা। দ্বিগুণ হয়ে গেছে শুকনো খাবারের দাম। বিদ্যুৎ না থাকার সময়ে মোমবাতি বিক্রি হয়েছে কয়েক গুণ বেশি দামে।
নেতিবাচক এসব খবর ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। এর বিপরীত চিত্রও আছে সিলেটে। বিপরীতটাই বরং শক্তিশালী।
সংকটে থাকা বানভাসিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্য সুহৃদ। ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চলছে সিলেটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ত্রাণ নিয়ে আসছেন মানুষজন। প্রবাসীরাও পাঠাচ্ছেন বিপুল টাকা।
অনেকে নিজেদের নৌকা দিয়ে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করছেন। বন্যার্তদের পারাপার ও ত্রাণসমগ্রী বিতরণে ভাড়া নিচ্ছেন না অনেক মাঝি।
সিলেটের বিভিন্ন হোটেল ও কনভেনশন সেন্টার তাদের রান্নাঘর উন্মুক্ত করে দিয়েছে বানভাসিদের খাবার তৈরির জন্য। বিনা মূল্যে বাবুর্চি দিয়েও সহায়তা করছেন তারা।
আক্রান্ত মানুষজনকে হোটেলে ফ্রি থাকারও সুযোগ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। ত্রাণসামগ্রী বিনা মূল্যে পরিবহনের ঘোষণা দিয়েছে বাস মালিক সমিতি।
এভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে নেমে পড়েছেন বন্যার্তদের সহায়তায়।
কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে।’ এই দুঃসময়ে সিলেটের বন্যাকবলিত মানুষদের সুসময়ে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ।
সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ পর্যাপ্ত আছে জানানো হলেও দুর্গম এলাকায় মানুষদের কাছে এখনও পৌঁছেনি তা। ফলে বন্যায় প্লাবিত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। এমন ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষেরা।
বন্যার শুরু থেকে পানিবন্দিদের উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বিনয় ভদ্র। নিজের নৌকা দিয়ে প্রথমে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার কার্যক্রম চালান তিনি। এখন বন্ধুদের নিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন তিনি।
বিনয় বলেন, ‘মঙ্গলবার আমরা কোম্পানীগঞ্জের খালিগাঁওয়ে ও নগরের মাছিমপুরে ত্রাণ বিতরণ করেছি। এসব এলাকায় আগে কেউ ত্রাণ নিয়ে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘এমন অনেককে আমরা পেয়েছি যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল নন, কিন্তু পানিবন্দি থাকায় তাদের ঘরেও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। তারাও বাধ্য হয়ে ত্রাণ নিচ্ছেন।’
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন রাশিদা বেগম। ছয় দিন ধরে আছেন এখানে। এর মধ্যে মাত্র এক দিন কিছু ত্রাণসামগ্রী পেয়েছিলেন জানিয়ে রাশেদা জানান, এক দিনের সামান্য খাবার দিয়ে ছয় দিন চলে না। তাই এই কয়েক দিন খেয়ে না খেয়ে ছিলেন।
নিজেদের উদ্যোগে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছেন সিলেটের কয়েক তরুণ। সালুটিকর ডিগ্রি কলেজে আশ্রিতদের খাবার সংকটের খবর পৌঁছে তাদের কাছে। মঙ্গলবার দুপুরে তারা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যান সেখানে। খাবার ছাড়াও জরুরি ওষুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করছেন বলে জানান বিনয়।
ত্রাণ বিতরণকারী দলের সদস্য বিমান তালুকদার বলেন, ‘আমরা গত তিন দিন ধরে নিজেরা চাঁদা তুলে সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করছি। প্রতিদিন ৩০০ মানুষকে রান্না করা খাবার এবং আরও ২০০ মানুষকে শুকনো খাবার প্রদান করছি।’
তিনি বলেন, ‘ত্রাণ বিতরণে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখছি, মানুষ প্রায় অভুক্ত অবস্থায় আছে। বিশেষত দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছছে না।’
সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। প্রশাসন থেকে পর্যান্ত ত্রাণ রয়েছে জানানো হলেও ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, তারা ত্রাণ পাননি। এ অবস্থায় দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য মানুষ।
সিলেটের বাইরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষজন প্রতিদিন ত্রাণ নিয়ে জেলাটিতে আসছেন। বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানও ত্রাণ বিতরণ করছে। ব্যক্তি আর বেসরকারি উদ্যোগে দেয়া ত্রাণই এখন পর্যন্ত ভরসা দুর্গতদের।
মঙ্গলবার ঢাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে সিলেট আসে একদল তরুণ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় দিনভর ত্রাণ বিতরণ করেন তারা।
এই দলের সদস্য শিহাব আহমদ বলেন, ‘ফেসবুক ও বিভিন্ন মিডিয়ায় মানুষের দুর্দশার চিত্র দেখে আমরা বন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলে এখানে খাবার নিয়ে এসেছি। ১ হাজার মানুষের মাঝে আমরা খাবার বিতরণ করেছি।’
সিলেট সদর উপজেলার হাটখোলা ইউনিয়নের পাখিমোড়া গ্রামের জমসেদ আলী সাত দিন ধরে পানিবন্দি। সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি তিনি। ত্রাণ নিয়ে আসেননি কোনো জনপ্রতিনিধিও, তবে কয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে সহায়তা দিয়েছে বলে জানান জমসেদ।
করোনাকালীন দুর্যোগে ‘কলের গাড়ি’ নামে স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম শুরু করেন সিলেটের নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা। সে সময় বিপাকে পড়া মানুষদের খাদ্য সহায়তা দেন তারা।
এবার বন্যা শুরুর পর আবার কলের গাড়ির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিদিন এক হাজার মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে এই উদ্যোগ থেকে।
এ বিষয়ে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু বলেন, ‘আমরা চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, স্যালাইন, ব্রেড, খাবার পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্রদান করছি। এ ছাড়া শিশুদের জন্য তরল দুধ দিচ্ছি।
‘প্রায় ৫০ জন নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেক জায়গায় গিয়েই আমরা দেখছি, মানুষজন খাবারের সংকটে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা তারা পাননি। পানি আরেকটু কমলে এবং মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে গেলে চাল, ডাল ও তেল বিতরণ শুরু হবে।’
নগরের কলিঘাটের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ী অনল পাল বলেন, ‘অসংখ্য মানুষ ত্রাণ দিচ্ছেন। প্রতিদিন কালিঘাটে ত্রাণসামগ্রী কেনার জন্য ক্রেতার ভিড় লেগে যায়। ক্রেতাদের প্রায় সকলেই সাধারণ মানুষ।’
ব্যাপক পরিমাণে ত্রাণ বিতরণের ফলে সিলেটে শুকনা খাবারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার সিলেট সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, বুধবার থেকে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া যাত্রীদের বিনা মূল্যে পরিবহন করবে তারা। এ ছাড়া সংকটে পড়া মানুষদেরও বিনা মূল্যে পরিবহন করা হবে।
সিলেট নগরের হোটেল ভ্যালি গার্ডেন, পানসী রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ তাদের রান্নাঘরে বানভাসিদের জন্য বিনা মূল্যে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খাবার বিতরণ করতে ইচ্ছুক যে কেউ এসব রান্নাঘর ব্যবহার করতে পারছেন। নিজেদের বাবুর্চিও দিচ্ছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
নগরের মুধশহীদ এলাকার হোটেল ফারমিস গার্ডেন কর্তৃপক্ষ বন্যাকবলিত মানুষদের তাদের হোটেলে বিনা ভাড়ায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে হোটেলটির সত্বাধিকারী ফারমিস আক্তার বলেন, ‘ব্যবসা তো সবসময় করি। এখন মানুষ বিপদে। এখন ব্যবসা নয়। আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। তাই আমার হোটেলে বানভাসিদের ফ্রি থাকার ব্যবস্থা করেছি।’
বিভিন্ন প্লাবিত এলাকায় প্রতিদিনই খাবার ও নতুন পোশাক বিতরণ করছেন বলে জানান ফারমিস।
প্লাবিত এলাকায় অনেক নৌকাচালকের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনই অনেক মাঝি বিনা ভাড়ায়ও পারাপার করছেন মানুষদের।
তেমনই একজন গোয়াইনঘাটের সারিঘাট এলাকার আব্দুল কুদ্দুস। নৌকা চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। তিনি ত্রাণসামগ্রী বিতরণে আসা কারও কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছেন না।
কুদ্দুস বলেন, দূরদুরান্তের মানুষজন সিলেটবাসীর জন্য খাবার নিয়ে আসছে। তারা অনেক কষ্ট করছে।
নিজের জায়গা থেকে এই সামান্য সহযোগিতা করতে পারবেন না কেন, সে প্রশ্ন করেন কুদ্দুস।
যতদিন বন্যা থাকবে ততদিন বিনা ভাড়ায় ত্রাণ বিতরণকারীদের পারাপার করবেন বলেও জানান এ মাঝি।
এমন আরেক মাঝির সহায়তার কথা উল্লেখ করে চিকিৎসক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট আলিম আল রাজি ফেসবুকে লেখেন, ‘গতকাল গোয়াইনঘাট এলাকার এক হাওর থেকে ফুপু এবং ফুপাতো ভাই-বোনদের উদ্ধার করে আনলাম। কোনো নৌকাই পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর শেষমেষ মাঝারি আকৃতির একটা নৌকা জোগাড় হয়েছিল। নৌকার চালক কম বয়সী; ১৭ বা ১৮ হবে বড়জোর।
‘বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে, কিছু জায়গা ঠেলে, কিছু জায়গা বৈঠা বেয়ে সে যখন সবাইকে নিয়ে আবার তীরে ফিরে এলো, তখন সে কোনো টাকাই নিতে চায় না। অনেক জোরাজুরির পর তার হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিয়ে এসেছিলাম।
ছেলেটির নাম ছিল বাসার। বাসারের কথাও টাইমলাইনে থাকুক।’
ত্রাণের কোনো সংকট নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘অসংখ্য মানুষ এই দুর্যোগে অসহায় বন্যাকবলিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যা আমাদের কাজকে আরও সহজ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ত্র্রাণের কোনো সংকট নেই, তবে নৌকা সংকটের কারণে প্রথমে ত্রাণ বিতরণে কিছু সমস্যা হয়েছিল। এখন সে সমস্যা কাটিয়ে উঠেছি।’