ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে সিল মারা গেলেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে এটা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইস) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বলেছেন, এই যন্ত্রে একজনের ভোট অন্যের দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
এই সুবিধার পরও ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে বলে মনে করেন সিইসি।
মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে ইভিএম যাচাই নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপে তিনি এমন মন্তব্য করেন। বলেন, ‘আমরা কিন্তু আপনাদের মতামত শুনছি। আপনাদের মতামতকে মূল্য দিচ্ছি। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফায় ১০টি এবং দ্বিতীয় দফায় ৮টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়। তবে আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেছে বিএনপি এবং তার তিন শরিক এবং ধর্মভিত্তিক আরও একটি দল।
এরপরেও আগামী ২৮ জুন নিবন্ধিত আরও ১৩টি দলের সঙ্গে বসার কথা রয়েছে কমিশনের।
ইভিএমে একজনের ভোট অন্যজন দিতে পারবে না উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) আমার ভোট আপনি, আর আপনার ভোট আমি এটা একেবারেই অসম্ভব।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রিসেন্টলি যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, আমরা কিন্তু কোনো সেন্টার থেকে কোনো এলিগেশন পাইনি যে, এটার (ইভিএম) অপব্যবহার হয়েছে।
‘আপনারা টিভিতে দেখেছেন যে দুয়েকজনের হাত মিলছিল না। তিনি বাসায় গিয়ে ধুয়ে আসার পরে আবার যখন আঙুলের ছাপ দিল, তখন কিন্তু আইডেন্টিফাই হয়েছে। যন্ত্রের কিছু কিছু সমস্যা হতে পারে। ব্যালটে যেমন একজনের জায়গায় ১০০টা (ভোট) দেয়া হতে পারে, এখানে একটা জিনিস হাত না মিলতে পারে। কিন্তু আমার ভোট আপনি, আর আপনার ভোট আমি এটা একেবারেই অসম্ভব।’
ইভিএম ও ব্যালটের প্রসঙ্গে টেনে সিইসি বলেন, ‘ব্যালটে আমার নিজেরও অভিজ্ঞতা আছে কীভাবে ভোটকেন্দ্র দখল করে এক ঘণ্টায় দুই-তিন শ সিল মেরে ভরাট করেছে। আপনারা পাশে থেকেও তো ওটা বন্ধ করতে পারেন নাই। সেই দিক থেকে ইভিএমে যদি কোনো দোষত্রুটি থেকে থাকে, আমি ইভিএম বিশেষজ্ঞ না, তারপরেও আমি এ পর্যন্ত যতটুকু ইভিএম দেখেছি ইতিবাচক দিকগুলো অনেক বেশি।’
দলগুলোর নেতাদের সিইসি বলেন, ‘আমরা জানি ইভিএম নিয়ে আপনাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। আমরা কিন্তু আপনাদের মতামত শুনছি। আপনাদের মতামতকে মূল্য দিচ্ছি। এরপর আরও ১৩টি দল আসবে। ওনাদের সঙ্গেও আমরা এভাবে মতবিনিময় করব।
‘আমরা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা সব দলের মতামত না দিয়ে সিদ্ধান্ত নেব না। এই জন্য আমরা এই প্রক্রিয়াটা গ্রহণ করেছি। আমরা আপনাদের মতামত বিশ্লেষণ করব, সেই সুযোগটা আমাদের রয়েছে।’
নির্বাচন কমিশন শতভাগ সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে- এই নিশ্চয়তাও দেন সিইসি। বলেন, ‘আমরা যারা কমিশনে আছি, তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কোনো কাজ করবে না, সরকারও চাইবে না আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করি।’
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে শতভাগ আস্থায় বিশ্বাস করি না। শতভাগ আস্থা কখনও হয় না। আপনি হারলে বলবেন উনি চোরামি করেছেন। আর উনি বলবেন আমি খুব সৎ। কারণ এই দ্বন্দ্ব থেকে যাবেই।’
‘গোপন কক্ষে অন্য কেউ বাটন চাপবে না’
ইভিএমে আঙুলে ছাপ দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত না করলে ভোট দেয়া সম্ভব নয়। তবে আঙুলের ছাপে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গোপন বুথে রাখা ইভিএমে গিয়ে অন্যদের ভোট দিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ ১৫ জুনের ভোটে যেন এমনটি না হয়, সেটি নিশ্চিত করার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। সব কেন্দ্রে রাখা হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, ‘গোপন কক্ষে অন্য কেউ বাটন চাপবে না, এই ব্যবস্থা আমরা করেছি। আমি আগেও বলেছি যে ইভিএম নিয়ে একটাই চ্যালেঞ্জ, যে সন্ত্রাসী অন্য কেউ চাপ দিয়ে দিল কি না। এ জন্যই আমরা সিসি টিভি ব্যবহার করেছি। ভবিষ্যতে সবগুলোতে না হলেও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ব্যবহার করব।’
‘কারচুপি সম্ভব নয়’
ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সাবেক এনআইডি মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘আগেরটা ভারতের আদলে তৈরি ইভিএম ছিল। মূলত ওটি ছিল কাউন্টিং মেশিন। এ ক্ষেত্রে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে সমস্যা হয়েছিল। ওটার টেকনিক্যাল দায়িত্ব ছিল বুয়েটের আর অন্য অংশটুকুর দায়িত্ব ছিল বিএমটিএফের।
‘পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন কমিশন নতুন কিছু চাইল। এরপর অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি টিম করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, যা যা প্রয়োজনীয় সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল বর্তমানে ইভিএম মেশিনে। সে সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল যেন হিউম্যান ইন্টারফেয়ারেন্স না করা যায়।’
বর্তমান ইভিএমে ব্যক্তি শনাক্ত না হলে ব্যালট ইউনিট ওপেন হবে না উল্লেখ করে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এতে কেউ কারও ভোট দিতে পারবে না। এখন গোপন কক্ষের মধ্যে তাকেই যেতে হবে।’
কোন দল কী বলল
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অনলাইন ভোটিংয়ের পরামর্শ দেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপির) প্রযুক্তিবিদ মহিউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে ভোট দিলে ভোটারদের কষ্ট কমে যাবে।’
ইভিএম মেশিনের কারণে আগের দিনে ভোট হবে না বলে দাবি করেছেন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সাংগঠনিক সচিব জাহাঙ্গীর আলম। বলেন, ‘ইভিএম গুড সিস্টেম৷ কারণ, ভোটের দিন ভোট হবে।’
ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব বলে মনে করেন খেলাফত মজলিসের একজন প্রতিনিধি।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ সালাউদ্দিন সালু বলেন, ‘দেশে সত্যিকারের একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।’
সভায় নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।