মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ছেড়ে প্রবাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নেয়া কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদ চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার উত্তরার বাসায় তার মৃত্যু হয় (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মহিউদ্দিন আহমদের ভাই মুনিরুদ্দিন আহমদ তার ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘মেজভাই চলে গেলেন। গত ৯ জুন আমার অসুস্থ মেজভাই জনাব মহিউদ্দিন আহমদের (সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কলাম লেখক) জন্য দোয়া চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তিনি আজ সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেছেন। তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য আমি আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আবারও আপনাদের দোয়া কামনা করছি।’
৮০ বছর বয়সী এই কূটনীতিক গত ১৫ বছর ধরে লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় গত মাসে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। প্রায় এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে গত সপ্তাহে তাকে বাসায় নেয়া হয়। তবে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। উত্তরার বাসভবন শিউলি তলায় পূর্ণ বিশ্রামে রাখা হয় তাকে।
পেশাদার কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে দ্বিতীয় সচিব থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন।
লন্ডনে প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে পৌঁছলে হিথ্রো এয়ারপোর্টে তাকে স্বাগত জানান এবং সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাকে চাকরিচ্যুত করে। তার ‘অপরাধ’ ছিল তিনি জাতিসংঘে তার অফিসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবির পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও টাঙিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে এবং পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে তিনি অবসর নেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালের ১৯ জুন ফেনীর নুরপুর গ্রামে মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম।
মৃত্যুকালে স্ত্রী বিলকিস আহমদ এবং একমাত্র কন্যা অরোরা আহমদ ছাড়াও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি। তার কন্যা অরোরা যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সচিব, কূটনীতিক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার রাতে এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইউরোপের পাকিস্তান দূতাবাসগুলোতে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালে তিনি লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনে দ্বিতীয় সচিবের পদ ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান জাতি সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক
সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক শোকবার্তায় বলেন, ‘মহিউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও সাহসী কূটনীতিক। তার মৃত্যুতে দেশ এক অমূল্য সম্পদ ও ব্যক্তিকে হারাল।
মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে নিজের দীর্ঘকালের সুসম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এক সমাবেশে সরকারি চাকরির মায়া ত্যাগ করে মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগের সাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ইউরোপে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করা বাংলাদেশি কূটনীতিক।’