টাঙ্গাইল-বেড়াডোমা-অমরপুর সড়কের লৌহজং নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুটি দেবে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ঠিকাদার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সেতুটি নির্মাণে শিডিউলের নির্দেশনা না মানায় এমন বিপর্যয় ঘটেছে বলে দাবি টাঙ্গাইল পৌরসভার সেতুসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণে স্ল্যাব ও গার্ডার ঢালাইয়ের সেন্টারিংয়ে এমএস পাইপের পরিবর্তে গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করেছে। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আরও বেশ কিছু অনিয়ম করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেতুটির একটি অংশ দেবে গেছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সেতুর সাব-ঠিকাদার ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিরুল ইসলাম খান।
টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শিব্বির আহমেদ আজমী জানান, ঠিকাদার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার কারণে সেতুটি দেবে গেছে।
পৌরসভা সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় টাঙ্গাইল পৌরসভা সেতুটি নির্মাণ করছে। ৮ মিটার প্রস্থ ও ৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ১৮ হাজার ৮৪১ টাকা।
২০২০ সালের ১২ নভেম্বর সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ঢাকার ব্রিকস অ্যান্ড ব্রিজ লিমিটেড এবং দি নির্মিতি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজটি শুরু করে। তারা কাজটি করতে সাব-ঠিকাদার হিসেবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিরুল ইসলাম খান ও প্যারাডাইসপাড়ার মো. জামিলুর রহমান জামিলকে দায়িত্ব দেয়।কাজের শিডিউল না মানার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম রশিদ আহম্মদ ৩০ মার্চ নোটিশ দেন।
নোটিশে বলা হয়, শিডিউলে স্ল্যাব ও গার্ডার ঢালাইয়ের সেন্টারিংয়ে এমএস পাইপ ব্যবহার এবং স্টিল সার্টার স্থাপনের নিদের্শনা মানা হচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস পাইপের পরিবর্তে গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করছে।
দ্রুত সেগুলো অপসারণ করে এমএস পাইপ ব্যবহারের নিদের্শনা দেয়া হয় নোটিশে।এর আগে ১৫ মার্চ টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শিব্বির আহমেদ আজমী একই নির্দেশনা দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেন।
সেসব নোটিশ গ্রহণ করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি শহরের প্যারাডাইসপাড়ার জামিলুর রহমান জামিল। দুবার নোটিশ পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১১ মে টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করা হয়।
তাতে বলা হয়, এমএস পাইপের পরিবর্তে গাছে গুঁড়ি ব্যবহারে ঢালাই চলাকালে সেতুটির কোনো প্রকার ক্ষতি হলে এর সব ক্ষতিপূরণ তারা (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) বহন করবে।
নোটিশ পাওয়ার পরও সাব-ঠিকাদার বেশি লাভের আশায় প্রকল্পের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন। ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত গার্ডারসহ সেতুটির স্ল্যাব ঢালাই করা হয়। ১৬ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেতুটির টপ স্ল্যাবসহ গার্ডার দেবে যেতে থাকে। রাত দেড়টার দিকে ১ হাজার ৩০ মিলিমিটার ডাউন হয়ে যায়।
পৌরসভা জানায়, এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে কর্তৃপক্ষ।স্থানীয়রা জানান, কাজের মেয়াদ ১১ মে শেষ হলেও ঢালাইয়ের এক মাস পরই সেতুটি ধসে পড়ায় পশ্চিম টাঙ্গাইলের লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘমেয়াদে বেড়ে গেল।
তাদের অভিযোগ, সেতুটি নির্মাণের টেন্ডার পায় ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে কাজটির সাব-ঠিকাদারি নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েজন নেতা। তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোনো নির্দেশনা না মেনেই ইচ্ছামতো কাজ করেছেন। এ কারণেই ঢালাইয়ের পর পরই সেতুটি দেবে যায়।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মো. সোলায়মান হাসান বলেন, ‘মূল ঠিকাদারকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে বর্তমান ঠিকাদাররা কাজটি হাতিয়ে নেন। যারা কাজ করছেন তারা কোনোদিন সেতু নির্মাণ দূরের কথা, কালভার্ট নির্মাণেরও অভিজ্ঞতা নেই। এর মধ্যে তারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করেছে।’
তিনি তদন্তপূর্বক ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
এ বিষয়ে সাব-ঠিকাদার ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিরুল ইসলাম খান জানান, কাজটি করছেন জামিলুর রহমান জামিল ও রাজ্জাক। তিনি কাজটি পাইয়ে দেয়ায় মধ্যস্থতা করেছেন। কাজটি খুবই সুন্দরভাবে হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেতুটি দেবে গেছে।
মোবাইল কল রিসিভ না করায় মূল দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য নেয়া যায়নি।
টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শিব্বির আহমেদ আজমী বলেন, ‘সাব-ঠিকাদারকে কয়েকবার নোটিশ দেয়া হয়েছে। তাতে ঢালাইয়ের সময় এমএস পাইপ ও স্টিল সার্টার ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়। তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করার কারণে সেতুটি দেবে গেছে।’
এ ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক বরাবর আবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।