‘কী কইমু, আমি তো একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেছি। ঘর, জিনিসপত্র সব ভাসাইয়া নিছে পানি। পানি হয়তো কমব, কিন্তু আমার যে ক্ষতি অইল, তা তো কোনোভাবে পুষাইত নায়।’
এ আক্ষেপ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বর্নি এলাকার আব্দুল আউয়ালের।
এই উপজেলার বিলাজুর এলাকার এরশাদ মিয়া চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘বন্যা সব নিয়ে গেছে। ঘরে গরু ও মুরগি ছিল, এগুলোও ভাসিয়ে নিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্রও স্রোতে ভেসে গেছে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। কেবল নিজেরা জীবন নিয়ে কোনোমতে আছি।’
সিলেটে চলমান বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা এই কোম্পানীগঞ্জ। এ উপজেলার প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গিয়েছিল পানিতে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। চার দিন ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ নেই সেখানে।
সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন এই উপজেলার বাসিন্দারা। নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে।
রোববার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ ঘুরে শোনা গেছে এসব মানুষের হাহাকার ও আর্তনাদ।
বিলাজুর এলাকারই মদরিছ আলী বলেন, ‘আমার ৫-৬টা মুরগি ছিল। পানি ভাসিয়ে নিয়েছে। কিছুদিন আগেই ধান ঘরে তুলেছিলাম। সেগুলাও নিয়ে গেছে। ঘরের বেড়াও ভাসিয়ে নিয়েছে স্রোত।
‘আমরা ঘরের চাল ধরে কোনো রকমে বেঁচে গেছি। কিন্তু সব হারিয়ে এখন বাঁচব কী করে?’
তিন দিন পানিবন্দি ছিলেন কোম্পানীগঞ্জের পাড়ুয়া গ্রামের আফিয়া বিবি। শনিবার সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গেছে।
সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে করে আফিয়া বলেন, ‘মনে হয়েছে আর বাঁচব না। খালি আল্লাহ আল্লাহ করেছি।
‘দিন তবু কোনো মতে কাটত। কিন্তু রাত ছিল ভয়ংকর। চারপাশ অন্ধকার। চারদিকে কেবল পানির শোঁ শোঁ শব্দ। একেকটা ঢেউয়ের চোটে মনে হয় আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’
পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি জানিয়ে আফিয়া বলেন, ‘কিছুই তো নাই। সব পানি নিয়ে গেছে। কেবল আমরাই বেঁচে আসছি।’
কোম্পানীগঞ্জের মতো পুরো সিলেটের চিত্রই এখন এমন। সবখানেই বন্যায় সব হারানোর আর্তনাদ।
সিলেট সদর উপজেলার রায়েরগাঁওয়ের মনির মিয়া বলেন, ‘এক কাপড়ে বাড়ির সদস্যদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। আর বাড়িঘরের খবর জানি না। কিছু আছে কি না তাও জানি না।’
সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের হিসেবেই সিলেট ও সুনামগঞ্জে পানিবন্দি আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ।
এমন তথ্য জানিয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিলেটের ৭০ শতাংশ ও সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে।’
শুক্রবার থেকে সিলেটে এবং শনিবার থেকে সুনামগঞ্জে বানভাসি মানুষের সহায়তায় কাজ করছে সেনাবাহিনী। শনিবার থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীও।
এদিকে রোববার থেকে সিলেটে কমতে শুরু করেছে পানি। বৃষ্টিও থেমেছে প্রায় ১০ দিন পর।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে কিছুটা কমেছে। তবে বেড়েছে কানাইঘাটে। অন্য নদীগুলোর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত আছে।