এই ভরা বর্ষায় দেশের উপকূল ও নিম্নাঞ্চলে যখন বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন পদ্মা সেতু খুলে দেয়া আশীর্বাদ বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে বন্যা শুরু হয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চল পেরিয়ে দক্ষিণেও আঘাত হানবে বলে আশঙ্কা সরকারপ্রধানের। বন্যার সময় খরস্রোতা পদ্মা পাড়ি দেয়া দুঃসাধ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে বন্যাকবলিত মানুষদের উদ্ধারকাজ, ত্রাণ কার্যক্রম বেগবান হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রোববার সকালে ‘সাফ চ্যাম্পিয়ন ২০২১ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী জাতীয় ফুটবল দল’-এর সংবর্ধনা ও আর্থিক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী ২৫ তারিখে (২৫ জুন ২০২২) আমাদের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করব। আমি মনে করি, পদ্মা সেতু এমন একটা সময়ে উদ্বোধন করতে যাচ্ছি, বন্যা একদিকে যেমন শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে বন্যা কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলেও যাবে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রোববার সকালে ‘সাফ চ্যাম্পিয়ন ২০২১ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী জাতীয় ফুটবল দল’-এর সংবর্ধনা ও আর্থিক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমও
১৯৯৮ সালের দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ঠিক সেই বন্যা শুরুর আগে যমুনা নদীর ওপর সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করে দিলাম। সেটা উদ্বোধন করেছিলাম বলেই সুবিধাটা হয়েছিল এই উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে সব কাজগুলো করা যাচ্ছিল।
‘বন্যায় যেহেতু আমাদের নদী অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে ওঠে, খরস্রোতা হয়ে ওঠে, যোগাযোগের সুবিধা থাকে না, কিন্তু সেই সময় আমাদের এই দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত ছিল। উত্তরাঞ্চল থেকে আমরা সব সময় সহযোগিতা পেয়েছিলাম। সে জন্য আমরা খুব সফলভাবে মোকাবিলা করেছিলাম।’
ওই সময় বিবিসি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বন্যায় দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাবে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, সে প্রসঙ্গটিও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘একটা মানুষকেও আমরা না খেয়ে মরতে দেব না। আমরা দিইনি। ওই সেতুটা তখন আমরা উদ্বোধন করেছিলাম, আমাদের বন্যা মোকাবিলায় অনেক সহযোগিতা করেছিল।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ঠিক আমি জানি না কেন আমার এই কথাটা মনে উঠল…আমরা ২৫ তারিখে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করব ইনশাল্লাহ। এই উদ্বোধনের ফলে আমি মনে করি যে এটাও একটা আল্লাহর আশীর্বাদ হবে।
‘কারণ আমরা দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগটা অব্যাহত রাখতে পারব। পণ্য পরিবহন, বন্যা মোকাবিলা, বন্যার সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সহযোগিতা করার একটা বিরাট সুযোগ আমাদের আসবে।’
বন্যার সময় খরস্রোতা পদ্মা নদী পাড়ি দেয়া কষ্টসাধ্য জানিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন টুঙ্গিপাড়ার মেয়ে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে। ৮৮-এর বন্যার সময় আমি টুঙ্গিপাড়া ছিলাম। আমি আসতে পারিনি ঢাকায়, আটকে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন যদি এ রকম পদ্মা সেতু থাকত, তাহলে চলে আসতে পারতাম।’
তিনি বলেন, ‘সেদিক থেকে এই সেতু উদ্বোধন করার পরে আমাদের এই সুযোগটা হবে, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে অন্তত আমাদের রিলিফ দেয়া, মানুষকে সাহায্য করা, ওষুধ দেয়া, সব ধরনের কাজ আমরা করতে পারব। আমার কেন যেন মনে হলো যে সময়টা বোধ হয় ওইরকমই আসে আমাদের জীবনে।’
পদ্মা সেতু নির্মাণে যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, সেদিকটাও উঠে আসে সরকারপ্রধানের বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সব থেকে খরস্রোতা নদী অ্যামাজন ও পদ্মা। এই পদ্মায় ব্রিজ আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি। তা ছাড়া অনেক বাধাও ছিল।’
সেই বাধা ডিঙানোর গল্প তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেই বাধা মোকাবিলা করেই কিন্তু অনেকটা নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছি যে আমাদের নিজেদের টাকায় এই সেতু করব। অর্থাৎ বাংলাদেশ পারে। কারও কাছে হাত পেতে না, কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে না, আমরা মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে চলব।’
দেশের অগ্রযাত্রায় করোনাভাইরাস কিছুটা বাধা তৈরি করেছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এ বাধা বাংলাদেশের জন্য কিছু না। এটা আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।…বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বিশ্বসভায় আমরা মাথা উঁচু করে চলব।’
৪৯৩ উপজেলায় শিগগিরই মিনি স্টেডিয়াম
দেশের ৪৯৩টি উপজেলায় দ্রুতগতিতে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৮৬টি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ চলছে জানিয়ে অবশিষ্ট সব উপজেলা মিলিয়ে একটি প্রকল্প উপস্থাপনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি এত দেরি চাই না। একটা-দুটো করে না। ৪৯৩টি উপজেলায় আমি মিনি স্টেডিয়াম রেডি চাই। যেখানে আমাদের ওই অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা খেলতে পারে এবং খেলার মধ্য দিয়ে তাদের মেধার বিকাশ হবে। এটাই আমি চাচ্ছি।’
প্রতিটি উপজেলায় খেলাধুলার সুযোগ করে দিতেই মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করে দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘এটা সুনির্দিষ্ট কোনো খেলার জন্য না, সব ধরনের স্পোর্টস, সব ধরনের খেলা যেন সেখানে অনুশীলন করতে পারে, খেলতে পারে, প্রতিযোগিতা করতে পারে সেই ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি।’
ভূমির অভাবে মাঠ নির্মাণ বন্ধ থাকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি জায়গা না থাকে তাহলে আমি টাকা দেব, জায়গা কিনে দেব। জায়গার জন্য ঠেকে আছে এটা যেন না হয়।’
গ্রামীণ খেলাধুলার ওপর আরও জোর দেয়া উচিত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় যদি আমরা ভালোভাবে সহযোগিতা না করি, সরকারের পক্ষ থেকে করতে পারি, বেসরকারি খাত থেকে করতে পারি, যত আমরা সহযোগিতা করব খেলাধুলার উৎকর্ষ তত বাড়বে। ঘর-সংসারের চিন্তা করব, নাকি খেলাধুলায় মনোযোগ দেব বা আমি সংস্কৃতিতে মন দেব, এই দোটানায় যেন না পড়ে।’
যারা খেলবে, দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে তাদের জীবন-জীবিকার সুযোগটাও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় মনে করি যে বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সুযোগ দেয়াই উচিত। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকেও এসব সুযোগ করে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাদের আর কোনো কাজ নেই তারা শুধু খেলাধুলাই করবে। যত বেশি ক্লাব হবে, তত বেশি প্রতিযোগিতা হবে, খেলাধুলায় তত বেশি উৎকর্ষতা বাড়বে। এটাই সব থেকে বড় কথা। কাজেই সে ধরনের পরিবেশ আমাদের তৈরি করতে হবে।’
দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খালি ব্যবসা করবেন, ইন্ডাস্ট্রি করবেন আর পয়সা বানাবেন সেটা তো হয় না। কিন্তু দেশের জন্য তো করতে হবে। সেটাই আমি চাই। আমার মনে হয় এই মেসেজটা আমাদের সব ব্যবসায়ীদের দিয়ে দেয়া উচিত।’
নিজের জীবদ্দশায় ক্রীড়া খাতে সহযোগিতা দেয়ার অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী। তার অবর্তমানে ক্রীড়াবিদদের কথা ভেবেই বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘চিরদিন তো আর থাকব না। কিন্তু একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত যেন হয় তার জন্যই এই ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন আমি করে দিয়েছি। সেখানে সিড মানিও দেয়া হয়েছে। যারা অসুস্থ, অসচ্ছল তাদের সহযোগিতাও করা হচ্ছে।’