গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শেখ মো. এনামুল হক ওরফে এনামুল করিমকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
বাহিনীর সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১-এর আভিযানিক দল শনিবার রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দীর্ঘদিন মসজিদের ইমাম ও হোমিও চিকিৎসকের ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনে ছিলেন এনামুল।
২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা এলাকায় ৭৬ কেজি ওজনের একটি বিশাল বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী তা নিষ্ক্রিয় করে।
এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানায় হত্যাচেষ্টা, হত্যার ষড়যন্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনটি মামলা হয়।
এর মধ্যে হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায় ২০২১ সালের ২৩ মার্চ আদালত এনামুলসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে কী জানাল র্যাব
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে রোববার সকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এনামুলের বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
তিনি বলেন, ‘তাকে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন এবং সেই বাসাতেই হোমিও চিকিৎসক পরিচয়ে ক্যানসার ও এইডস রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। ওই বাড়িওয়ালা তার সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য দেয় র্যাবকে।
‘এরপর নজরদারির পর এনামুলের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এনামুল জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।’
এনামুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ব্যবসায়িক সূত্র ধরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও তৎকালীন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজির আমির মুফতি আব্দুল হান্নানের সঙ্গে এনামুলের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তিনি ২০০০ সালে গোপালগঞ্জ শহরে বিসিক শিল্প নগরীতে মুফতি হান্নানের ছোট ভাই আনিসের সঙ্গে প্লট বরাদ্দ নিয়ে ‘সোনার বাংলা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে টুথপেস্ট, টুথ পাউডার, মোমবাতি ও সাবান তৈরির একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
মুফতি হান্নান ও অন্যান্য জঙ্গি নেতারা ২০০০ সালের জুলাইয়ে বেশ কয়েকবার তার কারখানা পরিদর্শন করেন। এনামুল বিভিন্ন সময়ে মুফতি হান্নানসহ অন্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক এবং সমাবেশে অংশ নিতেন।
র্যাব জানায়, মুফতি হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী এনামুল দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ায় তাদের সভাস্থলে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা নেন। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তারা কারখানায় সাবান তৈরির কেমিক্যাল সংগ্রহের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম জমা করেন।
তারা লোহার ড্রামে দুটি শক্তিশালী বোমা তৈরি করে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ায় জনসভার কাছে পুঁতে রাখেন। এই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে এনামুল ঢাকার মোহাম্মদপুরে আত্মগোপনে চলে যান।
পরবর্তী সময়ে এনামুল নিজের পরিচয় গোপন করে গাজীপুরের একটি মসজিদে ৮ বছর ইমামতি করেন। গাজীপুরে অবস্থানকালে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন।
র্যাবের কমান্ডার জানান, গাজীপুরে থাকাকালীন একটি হোমিওপ্যাথি কলেজে দুই বছর প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এনামুল। একইভাবে তিনি নিজেকে গাজীপুর হোমিও কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হিসেবেও পরিচয় দিতেন। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে তিনি ঢাকার উত্তরা ও বনশ্রীতে বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করেন।
তিনি জানান, এনামুল ঢাকার উত্তরায় ২০১৫ সালে ‘আই কে হোমিও কলেজ উত্তরা’ নামে একটি ভুয়া হোমিও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে তিনি ক্যানসার নিরাময় কেন্দ্র নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে ভুয়া হারবাল চিকিৎসা শুরু করেন। চিকিৎসায় ক্যানসার সম্পূর্ণরূপে ভালো হয় বলে দাবি করতেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এইডস রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাদানে সক্ষম বলেও দাবি করতেন।
র্যাবের ভাষ্য, এনামুল সব সময় নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে চিকিৎসা দিতেন। এ ছাড়া তিনি নিজেকে হেপাটাইটিস, প্যারালাইসিস, ডায়াবেটিস, মেদ, বন্ধ্যাত্ব, টিউমার, হার্ট, কিডনি, যৌন, মানসিক রোগসহ বহুবিধ রোগের সফল চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতেন। উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় যে বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন, তাতেই নিজের হোমিও চিকিৎসা চালাতেন। বাসার মালিক প্রাথমিকভাবে এনামুলের তথ্য জানালে পরে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয় র্যাব।