দুর্নীতিচেষ্টার মিথ্যে অভিযোগ এনে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভূতপূর্ব সাড়া ছিল বলেই সব বাধা পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে দৃঢ়তা দেখানো সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ হারিয়ে ক্ষুব্ধ নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের তদবিরের কারণেই দুর্নীতিচেষ্টার মিথ্যে অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়িয়েছিল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
রংপুরে পল্লী জনপদ এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমির (বাপার্ড) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
গণভবন প্রান্ত থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাই আমার দেশবাসীকে। আমি যখন ঘোষণা দিয়েছিলাম আমার দেশের টাকায় করব, তখন আমার দেশের মানুষ, তারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল যার যা আছে দেব, আমরা নিজের টাকায় করব। অনেকে আমাকে চেকও পাঠিয়েছে। যদিও আমি ভাঙি নাই, সেগুলো রেখে দিয়েছি।
‘এভাবে যে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া, এটা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। এটাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছিল। কারণ মানুষের শক্তিতে আমি বিশ্বাস করি। আজকে আমরা সেই পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে আমরা তৈরি করতে পেরেছি, এত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে।’
পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে পথটা মোটেও সহজ ছিল না বলে জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার সরকারের ওপর দুর্নীতির মিথ্যে অভিযোগ আনা হয় বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। আমরা এখানে দুর্নীতি করতে বসিনি। নিজের ভাগ্য গড়তে বসিনি। দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে এসেছি, দেশের উন্নয়ন করতে এসেছি।’
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুষেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশেরই একজন যে আমাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছে, সব থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা যে আমার কাছ থেকে নিয়েছে তারই বেঈমানির কারণে এই পদ্মা সেতুর টাকাটা বন্ধ হয়ে যায়।
‘কারণ একজন ব্যক্তি একটা ব্যাংকের এমডির পদ…আমাদের তো এখন প্রায় ৫২/৫৩টি ব্যাংক আছে। প্রত্যেক ব্যাংকেই তো একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আছেন। কতজন পারে বিদেশে টাকা বানাতে? অথবা লাখ লাখ ডলার ডোনেশন দিতে বা বিদেশ ঘুরে বেড়াতে কে পারে?’
নোবেল বিজয়ী ইউনূস কী কী সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন, সেটাও সবিস্তারে তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য হলো যে সব থেকে বেশি আমি তাকে সুযোগ দিয়েছি। গ্রামীণফোন ব্যবসাটা আমার আমলে আমি তাকে দিয়েছিলাম। এবং তাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক যখন একেবারে বসে যাচ্ছিল তখন সে গ্রামীণ ব্যাংক চালু রাখার জন্য…
‘৯৮ সাল আমাদের জন্য খুব একটা…কারণ বিশাল বন্যা ছিল। সেই অবস্থায়ও আমাদের রিজার্ভ খুবই কম। সবদিক থেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ইয়ে ছিল। এশিয়াব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। তারপর দীর্ঘ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত।
‘সে অবস্থাতেও এই ব্যাংকটা যেন চালু রাখতে পারে প্রথমে ১০০ কোটি, তারপর ২০০ কোটি, এরপর আরও ১০০ কোটি–মোট ৪০০ কোটি দিয়ে ব্যাংকটা চালু রাখার সুযোগ করে দিই।’
গ্রামীণফোন প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোনের ব্যবসাটা দিই যাতে ফোনের লভ্যাংশটা গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে। জীবনে এক পয়সাও যায়নি। শ্রমিকদের পাওনা টাকাটা দেয় না, তো আর কী দেবে? সেটা হচ্ছে আমাদের দেশের নোবেল লরিয়েট ডক্টর ইউনূস।’
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ফিরে পেতে ড. ইউনূসের মরিয়া হয়ে ওঠার গল্পটাও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদটা ছাড়বেন না, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদটা ছাড়বেন না। যদিও আইন আছে ৬০ বছর। তার তখন ৭০ পার হয়ে গেছে। ১০ বছর তিনি বেআইনিভাবে এমডি থেকেছেন। তারপর আরও থাকবেন।
‘তাকে আমাদের তরফ থেকে বলা হয়েছিল উপদেষ্টা থাকেন। আপনাকে সম্মান দিয়ে রাখা হবে। সেটাও তিনি মানেননি। সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। আর মামলায় যথাযথভাবে হেরেও গিয়েছিলেন।
‘কারণ কোর্ট আর যাই পারুক, তার বয়স তো আর ১০ বছর কমাতে পারেনি। যদি কমাতে পারত হয়তো কমিয়ে দিত, এটা আমি জানি। কিন্তু কমাতে পারেনি। হেরেও গিয়েছিলে।’
ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে দেয়া তার অনুদান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি তদবির করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে দিয়ে, হিলারি ক্লিনটন তার বন্ধু ছিল, সে ছিল আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে তিনি মোটা অংকের চাঁদাও দিয়েছিলেন। অনুদান দিয়েছিলেন। জানিনা এত টাকা কোথা থেকে পেল, কিন্তু সেটাও দিয়েছিল।
‘কাজেই সেই আমেরিকান সরকারকে ধরে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমার পদ্মার টাকা বন্ধ করে দেয়। আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেয় কানাডার কোর্টে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে, যে দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। আমি এমনিতে মেনে নেব না।
‘প্রমাণ দিতে হবে, প্রমাণ দিতে পারেনি। তখন বলেছিলাম টাকা লাগবে না আপনার নিজের টাকায় করব।’
কানাডার কোর্টের রায় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কানাডার কোর্ট রায় দিয়েছে যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে সমস্ত অভিযোগ এনেছে সব ভুয়া, মিথ্যা, দুর্নীতির কোনো অভিযোগই এখানে টেকেনি। আমরা আমাদের পক্ষে রায় পেয়ে গিয়েছিলাম। শত বাধার মুখে বল আমি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করতে পেরেছি।’