রাজধানীতে আগুন নেভানোর জন্য পানির উৎস খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। বনানীর এফ আর টাওয়ার ও পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভবনে আগুন লেগে মারা যান মোট ৯৩ জন। আশপাশে পানির কোনো উৎস ছিল না।
আগুন নেভাতে পানির প্রাপ্যতা সহজ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফায়ার হাইড্র্যান্ট (অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত স্থায়ী পানিকল) স্থাপনের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। ২০১৯ সালে এক বৈঠকে ওয়াসাকে এ পরামর্শ দেয়া হয়।
বৈঠকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, চুড়িহাট্টা ও বনানীতে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর পানির উৎস খুঁজে পেতে বেগ পান। এ প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে রাজধানীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপনের কথা বলেন তিনি।
বৈঠকের পর তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও রাজধানীতে একটিও ফায়ার হাইড্র্যান্ট স্থাপন করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশন, কারও কাছ থেকেই এর কারণ সম্পর্কে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
২০২১ সালের ৮ জুন রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা ও ত্রাণ বিতরণের সময় মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বস্তিবাসীদের কল্যাণে বস্তিগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করতে ফায়ার হাইড্র্যান্টের ব্যবস্থা করা হবে।
চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর পানির উৎস খুঁজে পেতে বেগ পান। ফাইল ছবি
আগুন নেভানোর কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা।
পানি সংরক্ষণাগারের সঙ্গে সংযুক্ত বিশেষ পানিকল হচ্ছে ফায়ার হাইড্র্যান্ট। সাধারণত রাস্তার কাছে এই কল স্থাপন করা হয়। এর সঙ্গে পাইপ যুক্ত করে এই পানি আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করতে পারেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) আব্দুল হালিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ফায়ার হাইড্র্যান্ট নাই। অনেক সময় এটি নির্মাণের কথা বলা হলেও আমরা এর বাস্তব রূপ দেখছি না। ফায়ার হাইড্র্যান্ট খুবই প্রয়োজন। তবে সব থেকে বেশি প্রয়োজন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নাই। সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার সমন্বয় হলে ফায়ার হাইড্রান্ট তৈরি করা সম্ভব।’
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (অয়্যারহাউজ ও ফায়ার প্রিভেনশন) আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের কোথাও সরকারিভাবে ফায়ার হাইড্র্যান্ট নেই। বিভিন্ন শিল্প কল-কারখানা, ভবনের মালিক যারা আছেন তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে, নিজস্ব ভবন রক্ষায় এটা তৈরি করে থাকেন।’
বনানীর এফ আর টাওয়ারের আশপাশে পানির কোনো উৎস ছিল না। ফাইল ছবি
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্তব্য করেন, ‘খাবার পানিই ঠিক মতো ব্যবস্থা করতে পারে না, আর ফায়ার হাইড্রান্ট!’
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে ফায়ার হাইড্র্যান্ট দরকার ছিল এবং থাকা উচিৎ। এটার একটা মাস্টার প্ল্যান থাকে, অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এর জন্য সমন্বয় এবং তহবিল জরুরি। অনেকে নিজস্ব ভবনে পানি রিজার্ভে রাখে। এটা ভালো দিক।’
ঢাকা শহরের অনেক বড় পানির উৎস পুকুর। দিন দিন এই পুকুরগুলো ভরাট করে ফেলা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নজরুল ইসলাম। বলেন, এই কারণেই ফায়ার হাইড্র্যান্ট খুব দরকার।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ভবনগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা খুব কম থাকে। রাজউক, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলো সচেতনতা বাড়ানো। তবে এইটা আমাদের এখানে সেভাবে হয় না। টেলিভিশনকে এই কাজে ব্যবহার করতে পারে।’
তবে এরই মধ্যে ফায়ার হাইড্রান্ট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তবে কবে কতদিনে তা বাস্তব রূপ নেবে সেটা জানাতে পারেনি তারা।
উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফায়ার হাইড্র্যান্ট নির্মাণের জন্য আমরা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এটার টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি স্থাপন হয়ে যাবে।’
ফায়ার হাইড্রান্ট নির্মাণে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কতদিনে স্থাপন হবে সেটা এখনি বলতে পারছি না। ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করেই ফায়ার হাইড্র্যান্ট প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছি।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ফায়ার হাইড্র্যান্টের স্থাপনের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নাই। তাদের মতে, ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রস্তাব না আসার কারণে এ বিষয়ে তারা কিছুই ভাবছেন না।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস থেকে আমরা যদি কোনো প্রস্তাব পাই, তখন সেই জায়গা ঠিক করে করব। আমরা যেটা করছি, যে সমস্ত জায়গায় জলাশয় আছে, সেখানে পানির সোর্স তৈরি করছি।
‘আমাদেরকে বলতে হবে কোন এলাকায় ঝুঁকি বেশি, সেই জায়গা প্রস্তাব আকারে দিতে হবে। তখন আমরা যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেব।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েও কোনো ফল পাননি বলে জানান তিনি।
প্রতিমন্ত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফায়ার হাইড্র্যান্ট কোনো ফলাফল নাই। গত মাসে এটা নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেয়া হবে। সেই আলোচনা সাপেক্ষে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু ওখান থেকে এখনও সিদ্ধান্ত দেয়া হয় নাই।’
ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এটা করে। ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে এটা করতে হবে। ওয়াটার হাইড্র্যান্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে। সেখানে আমার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, এটার কোনো অগ্রগতি এখনও নাই।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত জিনিসটার গুরুত্ব দিতে হবে। চিঠি দিলে যদি কাজ হয়ে যেত তাহলে তো হতই। এটা করে নিয়ে আসা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। যাদের ফায়ার হাইড্র্যান্ট করার কথা, তারা নানা অজুহাত দিতে পারে। কিন্তু এটার গুরুত্ব অনুধাবন করে এটা করতে হবে। মন্ত্রী আলোচনা করে যদি ফল না পান, তাহলে শোরগোল করবেন যে, কেন এটা হচ্ছে না।
‘কিন্তু তিনি তো সেটা করেন নাই। যেখানে চিঠি দিয়েছেন, তাদের যেমন দায়িত্ব, যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদেরও দায়িত্ব আছে। এ ছাড়া পানির আধারগুলোও সংরক্ষণ করতে হবে। যে হারে বহুতল ভবন বাড়ছে, তাতে ফায়ার হাইড্র্যান্ট না করা হলে সামনে বিপদ।’
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যেক ভবনে নকশা অনুমোদন দেয়ার সময় আমরা ফায়ার হাইড্র্যান্ট নিশ্চিত করি।’
তবে ঢাকায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট কোথাও দেখা যায় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন ভবনগুলোতে হচ্ছে। ঢাকা শহর তো অনেক পুরোনো শহর। পুরাতনগুলোতে নেই, নতুনগুলোতে আমরা নিশ্চিত করছি। সামনে এটা নিয়ে আরও কাজ হবে।’