পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হচ্ছে ২৫ জুন। তাই সেতুকে ঘিরে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের। এর মাঝেও আছে ব্যতিক্রম। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দৌলতদিয়া ঘাটের স্থানীয় ব্যবসায়ী ও হকারদের।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দৌলতদিয়া ফেরি রুটে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ অনেকটাই কমে যাবে। ফলে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার খাবার হোটেল থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ দোকান ও হকারদের ব্যবসায় ভাটা পড়বে।
যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রভাব পড়েছিল টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের গোবিন্দাসী ঘাট ও সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের ঘাটে। একসময়ের ব্যস্ততম এই দুটি ঘাটের ব্যবসায়ীদের বড় অংশই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি চলাচল অব্যাহত থাকায় পদ্মা সেতুর প্রভাব ততোটা হয়তো পড়বে না। তবে যেটুকু পড়বে তা এখানকার ব্যবসায়ীদের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
দৌলতদিয়া ঘাট এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘এই পাড়ে দেড় শতাধিক টং দোকান রয়েছে। যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কমে গেলে আমাদের ব্যবসাও কমে যাবে। তখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।’
দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় দুই শতাধিক খাবার হোটেল রয়েছে। তাছাড়া ভ্যানে বা মাথায় করে পেয়ারা, ডাব, আনারস, ডিম ও ঝালমুড়ি বিক্রি করে তিন শতাধিক ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। পদ্মা সেতু চালুর পর এই ফেরি রুটে যাত্রী ও যানবাহন কমে গেলে বেচাবিক্রি কমে যাওয়ার শঙ্কা এসব হকারের।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া (কুমারখালী, খোকসা), ফরিদপুর (সদর) থেকে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ার যানবাহনগুলো দৌলতদিয়া ঘাট হয়েই যাতায়াত করবে। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায় আশঙ্কার চেয়ে কম মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিআইডব্লিউটিসি বলছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর কতসংখ্যক যানবাহন ও যাত্রীর চলাচল এই নৌপথ দিয়ে অব্যাহত থাকবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সে বিষয়ে ধারণা পেতে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
দৌলতদিয়া ঘাটের গ্রামীণ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক টিটু শেখ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘মাসে আমার প্রায় এক লাখ টাকা শুধু দোকান বাবদই খরচ হয়। সে খরচ তুলে বাকি আয়টুকু দিয়ে আমার সংসার চলে। ব্যবসায় এখনই মন্দা অবস্থা। পদ্মা সেতু চালু হলে দোকান বন্ধ করে চলে যেতে হবে।
আরেক ব্যবসায়ী লোকমান ফকিরের খাবারের দোকান ‘ভাই ভাই হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট’ দৌলতদিয়া লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বের হলেই চোখে পড়ে। তার কণ্ঠেও হতাশার সুর। বললেন, ‘যানবাহন ও যাত্রী কমে গেলে আমাদের এক প্রকার না খেয়ে থাকতে হবে। হোটেল ভাড়া, কারেন্ট বিল, কর্মচারীর বিল দিয়ে আমরা হোটেল চালাতে পারব না।’
কয়েকজন হোটেল কর্মচারীর সঙ্গে নিউজবাংলার কথা হয়। তারা বলেন, ‘যাত্রী আর গাড়ি না থাকলে মালিকের বেচাকেনা হবে না। আগের মতো রমরমা অবস্থাও থাকবে না। তখন আমাদের চাকরিও থাকবে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় থাকব? নদীভাঙন আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। এবার চাকরির সুযোগটুকুও বুঝি আর থাকছে না।’
দৌলতদিয়া বাস টার্মিনাল এলাকার ঘোল ব্যবসায়ী রতন ঘোষ বলেন, ‘এই ব্যবসা আমার বাপ-দাদার আমলের। এমনও দিন গেছে, তিন থেকে চার পাতিল ঘোল বিক্রি করেচি। সেতু চালু হলে এদিকে না জানি কী হয় ব্যবসার! কারণ এখানে কেবল বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাই আমাদের কাস্টমার।’ছোট মুদি দোকানি আনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘এটা তো কোনো জেলা শহর না। মানুষ এমনিতেই আসবে না। ঘাটে যাত্রী ও গাড়ি পারাপার হতো বলে মানুষ আসা-যাওয়া করত। পদ্মা সেতু চালু হলে এই নৌপথে যাতায়াত করা মানুষের সংখ্যা কমে যাবে। তখন আমাদের দোকানও বন্ধ করে দিতে হবে।’
ভ্যানে লেবুর শরবত বিক্রি করেন আকবর। তিনি বলেন, ‘এখন যাত্রীর চাপ আছে। গরমের সময় ভালোই বিক্রি হয়। যাত্রী কমে গেলে তখনকার অবস্থা নিয়ে শঙ্কায় আছি।’
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক লীগ দৌলতদিয়া শাখার সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন তপু বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে এই ঘাট এলাকায় প্রায় এক হাজার হকার, এক শ হোটেল, দুই শ ছোট ব্যবসায়ী ও দুই শ বাড়িকেন্দ্রিক যে ব্যবসা আছে তা শেষ হয়ে যাবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। তারা পেশা পাল্টাতে বাধ্য হবে।
‘সরকার এর আগে দৌলতদিয়ায় নৌবন্দর স্থাপন করতে চেয়েছিল। সেটি স্থাপন হলেও এখানকার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ভালো হতো। অন্তত এই অঞ্চলের অর্থনীতি নুয়ে পড়ত না। আশা করি, সরকার দ্রুতই এখানে নৌবন্দর স্থাপনে কাজ শুরু করবে।’
তবে রাজবাড়ী বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি মুরাদ হাসান মৃধার অভিমত ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের পরিবহন ব্যবসায় কোনো রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তখন বরং আমরা স্বল্প সময়েই ফেরি পাব। দুর্ভোগ কমবে।
‘রাজবাড়ী, ফরিদপুর (সদর), মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া (কুমারখালী)- এসব রুটের যাত্রীরা এই ঘাটই ব্যবহার করবেন। ২১ জেলার চাপ না থাকায় তখন এই কয়েক জেলার যাত্রীরা অনেকটা দুর্ভোগহীন যাতায়াত করার সুযোগ পাবেন।
তবে পদ্মা সেতু চালুর পর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে কটি ফেরি চলবে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না বিআইডব্লিউটিসি।
বিআইডব্লিউটিসি আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম ও পাটুরিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, ‘যানবাহন ও যাত্রী সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ফেরি চলবে। লাইট ট্রাক বিশেষ করে এক, দেড়, আড়াই ও তিন টনের ছোট পিকআপ পদ্মা সেতু হয়ে ২১ জেলায় যাতায়াত করবে। তবে সেতু চালু হলেও পণ্যবাহীসহ বড় ট্রাক আগের মতোই এ নৌপথ ব্যবহার করবে।’ রাজবাড়ীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিশেষ করে গাবতলী থেকে ছেড়ে আসা পরিবহনগুলো দৌলতদিয়া ঘাট দিয়েই পারাপার হবে বলে তিনি মনে করেন।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সে বিষয়ে খালেদ নেওয়াজ বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর এক-দুই সপ্তাহ পরই পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’