করোনা মহামারিসহ নানা কারণে কয়েক দফা পেছানোর পর অবশেষে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২, চলবে ২১ জুন মঙ্গলবার পর্যন্ত।
অর্থাৎ ১৪ জুন দিবাগত রাত ১২টা (শূন্য মুহূর্ত ১৫ জুন) ‘শুমারি রেফারেন্স পয়েন্ট/সময়’ হিসেবে এবং ১৫ থেকে ২১ জুন ‘শুমারি সপ্তাহ’ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে; চলবে ২১ জুন পর্যন্ত। এটি দেশের ষষ্ঠ জনশুমারি।
দেশের মোট জনসংখ্যা এখন কত, তা জানতেই মূলত মঙ্গলবার রাতে রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, কারওয়ান বাজার, বাসস্ট্যান্ডসহ সারা দেশে এ ধরনের স্থানগুলোতে ভাসমান মানুষকে গণনাসহ তাদের সম্পর্কে মৌলিক জনমিতিক, আর্থ-সামাজিক ও বাসগৃহসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে শুরু হবে জনশুমারি।
প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনশুমারি ও গৃহগণনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ গণনার সময় মানুষের কাছ থেকে কাগজে-কলমে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হবে না। জনশুমারিতে নিয়োজিত কর্মীরা ট্যাবের মাধ্যমে সব তথ্য সংগ্রহ করবেন। গণনার সব ধরনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
আগের পাঁচটি আদমশুমারির তথ্য খাতা-কলমে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। এ সময় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমসহ বিবিএসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সরকারের তথ্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। আর বিবিএসের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম জনশুমারি; কিন্তু এবারের ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্পটি বার বার হোঁচট খেয়েছে।
বেশি দামে ট্যাব (ট্যাবলেট কম্পিউটার) কেনা, দরপত্রে কঠিন শর্ত আরোপসহ বেশ কিছু বিষয় সমালোচিত হওয়ায় এবং করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পটির কাজ শুরু বারবার পিছিয়েছে। জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের জন্য ট্যাব কেনার প্রস্তাব দুইবার বাতিল করে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা।
২০২১ সালের মধ্যেই শুমারি শুরুর আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল। এ জন্য প্রথমে গত বছরের ২ থেকে ৮ জানুয়ারি জনশুমারি করার কথা ছিল, যা করোনার কারণে পিছিয়ে যায়। পরে ২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর করার সিদ্ধান্ত হয়। ট্যাব জটিলতায় তা শুরু করা যায়নি। পরে ২৪ থেকে ৩০ ডিসেম্বর শুমারি সপ্তাহ ধরে জনগণনা করার কথা ছিল, কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি।
শেষ পর্যন্ত ১৫ থেকে ২১ জুন ‘শুমারি সপ্তাহ’ হচ্ছে।
আগে জনশুমারির নাম ছিল আদমশুমারি। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘পরিসংখ্যান আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী ‘আদমশুমারি ও গৃহগণনা’র নাম পরিবর্তন করে ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে তাজুল ইসলাম জনশুমারি ও গৃহগণনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, ‘দেশের প্রতিটি খানা ও খানার সদস্যকে গণনা করে দেশের মোট জনসংখ্যার হিসাব করা হবে। কেউ যাতে এ গণনা থেকে বাদ না যায় এবং একজন যাতে দুবার গণনার মধ্যে না আসে-সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।‘
জাতীয় স্বার্থে এই গণনা কাজে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, ‘নিজে গণনায় অংশ নিন। অন্যকে উৎসাহিত করুন।’
গণনা শেষে তিন মাসের মধ্যে জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করা হবে। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হবে তার পরে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘জনশুমারি একটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবারই প্রথম আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণনা করছি। এ কাজে জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেউ যাতে এই গণনা থেকে বাদ না যায়, সে জন্য গণনাকর্মীকে যেমন নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে; তেমনি দেশের প্রতিটি মানুষকেও সচেতন থাকতে হবে, যেন তিনি বাদ না পড়ে যান।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সকল মানুষ ও অঞ্চল ভিত্তিক সুষম উন্নয়নের জন্য সঠিক তথ্যের প্রয়োজন। এই শুমারির মাধ্যমে দেশে কোন অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের কী অবস্থা তা বের হয়ে আসবে। পরবর্তীতে সরকার সেই রুপ রেখা ধরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৮১ সালে দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালে তৃতীয়, ২০০১ সালে চতুর্থ ও ২০১১ সালে পঞ্চম জনশুমারি হয়। পরিসংখ্যান আইন ২০১৩ অনুযায়ী 'আদমশুমারি'কে 'জনশুমারি' হিসেবে অভিহিত করা হয়। জনশুমারি ও গৃহগণনা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পরিচালিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাপকভিত্তিক পরিসংখ্যানিক কার্যক্রম।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে, তখন দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। দ্বিতীয় আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয় ১৯৮১ সালে; তখন জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৯৯ লাখ।
১০ বছর পরপর দেশে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা যথাক্রমে ১৯৯১, ২০০১, ও ২০১১ সালে হয়। ওই তিন গণনায় দেশের মোট জনসংখ্যা পাওয়া যায় যথাক্রমে ১১ কোটি ১৫ লাখ, ১৩ কোটি ৫ লাখ এবং ১৪ কোটি ৯৮ লাখ।
শুমারিগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রতি দশ বছরে গড়ে প্রায় ২ কোটি করে পেয়েছে।
পৌনে ৪ লাখ গণনাকারী
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সারাদেশে একযোগে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৭ জন গণনাকারী ট্যাবের সাহায্যে সাতদিন ধরে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এই শুমারি পরিচালনা করবেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
জনশুমারির প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত শুন্য সময় থেকে দেশের প্রায় ২০ হাজার স্পট থেকে ভাসমান ও ছিন্নমুল মানুষ গণনার মাধ্যমে শুরু হচ্ছে ষষ্ঠ জনশুমারি। বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ভাসমান মানুষ গণনা করা হবে। এরপর সকাল ৮টা থেকে শুমারির মুল কাজ শুরু হয়ে ২১ জুন এই শুমারি শেষ হবে।’
দেশব্যাপী প্রায় ৪ লাখ ট্যাব ব্যবহার করে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সম্পন্ন করা হবে বলে জানান তিনি।
‘এবারের শুমারিতে ৬৩ হাজার ৫৪৮জন সুপারভাইজার, ৩ হাজার ৭৭৯ জন আইটি সুপারভাইজার, ৩ হাজার ৭৭৯ জন জোনাল অফিসার, ১৬৩ জন জেলা শুমারি সমন্বয়কারী এবং ১২জন বিভাগীয় শুমারি সমন্বকারীর মাধ্যমে এই ডিজিটাল শুমারি সম্পন্ন করা হবে।’
দিলদার বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল এই শুমারির ট্যাবগুলোতে ইন্টারনেট সেবা দেবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি। একজন গণনাকারী প্রতিটি খানার তথ্য নিয়ে তার ট্যাবে থাকা প্রশ্নপত্র পূরণের মাধ্যম তথ্য সংগ্রহ করবেন। একটি প্রশ্নপত্র পূরণ হওয়ার সাথে সাথে তা সয়ংক্রিয়ভাবে রবি‘র মাধ্যমে আই ক্লাউড হয়ে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানির ডাটা সেন্টারে জমা হবে। সেখান থেকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডাটা সেন্টারে জমা হবে।’
‘এবারের শুমারিতে একজন মানুষের কাছ থেকে মোট ৩৫টি তথ্য নেওয়া হচ্ছে। কোনও পরিবারের সদস্য বিদেশে থাকলে তাকে গণনায় অনর্ভূক্ত করা হবে। আবার যদি কোনও বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করেন তাকেও গণনাই নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, এবারের শুমারিতে দেশের প্রতিটি খানা ও খানার সদস্যদের গণনা করে মোট জনসংখ্যা ও দেশের সকল বসতঘর বা বাসগৃহের সংখ্যা নিরূপণ করা হবে।’
দেশের সব নাগরিককে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে সহযোগিতার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব তথ্য গোপন রাখা হবে।’