একই দিনে স্বামী ও সন্তানকে হারিয়ে আহাজারি করছেন আবেদা খাতুন। কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। মাথায় পানি ঢালছেন স্বজনরা। কেউ আবার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।
পাশের ঘরেই তার ছেলে ওয়াসিমের স্ত্রী রুনা। ১০ বছর বয়সী ছেলে জুনায়েদ আর আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রাফাকে নিয়ে এক রকম দিশেহারা তিনিও।
বারবার দুই সন্তানকে দেখিয়ে আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘এখন আমি সন্তানদের নিয়ে কীভাবে চলব? ওদের বাপ-দাদা দুজনই চলে গেলেন একদিনে। এই শোক আমরা সইবো কি করে?’
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাইদ ইউনিয়নের হালগড়া গ্রামে মঙ্গলবার সকালে এই দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
সোমবার বিকেলে উপজেলার বড়িবাড়ী ইউনিয়নের এন সহিলা হাওরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন তিনজন। মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ওই তিনজন হলেন করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাইদ ইউনিয়নের হালগড়া গ্রামের ৬০ বছরের সিরাজ উদ্দিন ও তার ছেলে ৩৫ বছরের ওয়াসিম এবং তাড়াইল উপজেলার দামিহা এলাকার ২৫ বছরের মাসুদ মিয়া।
তাদের মধ্যে সিরাজ ও ওয়াসিম সম্পর্কে বাবা-ছেলে। তাদের বাড়ি করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাইদ ইউনিয়নের হালগড়া গ্রামে।
আরেকজনের নাম মাসুদ মিয়া। তার বাড়ি তাড়াইল উপজেলার দামিহা এলাকায়।
ওয়াসিমের চাচাতো ভাই শরীফ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইটনা সদর ইউনিয়নের বেতেগা হাওরে তার চাচা সিরাজ উদ্দিনের কৃষিজমি ও মাছ ধরার কয়েকটি খাঁদ রয়েছে। সেই খাঁদে গাছের ডালপালা ফেলার জন্য একটি নৌকায় করে গিয়েছিলেন তারা চাচা ও চাচাতো ভাই ওয়াসিম।
‘গতকাল দুপুরে আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে দুর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া অসীম ও নিজামুল হকের কাছ থেকে ঘটনা শুনি।’
তাদের বরাতে শরীফ বলেন, ‘দুপুরে বড়িবাড়ী ইউনিয়নের এন সহিলা গ্রামের সামনের হাওরে পৌঁছানর পর প্রচণ্ড ঝড় হয়। হাওরে নৌকা নোঙর করে তারা সবাই ভেতরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় হঠাৎ নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকার ভেতর থেকে মাঝি অসীম ও নিজামুল হক বের হয়ে সাতরিয়ে একটি মাছের নৌকায় উঠে বেঁচে যান।
‘আর ভেতরে আটকা পড়েন সিরাজ উদ্দিন, তার ছেলে ওয়াসীম ও আরেক যাত্রী মাসুদ। পরে খবর পেয়ে ইটনা থানার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে তাদেরকে উদ্ধারের কাজ শুরু করে। তবে তখন তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সকালে আবারও উদ্ধার অভিযান শুরু করলে সকাল ৯টার দিকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।’
সিরাজ উদ্দিনের ছোট ভাই জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার বড় ভাই সিরাজ ও তার ছেলে ওয়াসিমই ছিল এ পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুর্ঘটনায় একসঙ্গে তাদের দুজনের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসল।’
তিনি জানান, ওয়াসিমের এক ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়েটা কেবল হাঁটতে শিখেছে।
নোয়াবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এই পরিবারের দুইজন সদস্যদের এমন মৃত্যুতে পরিবারটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পেলে, কোনো মতে তারা চলতে পারবে।’
করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘সংশিষ্ট চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে। আবেদন পেলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’