রাত পোহালেই নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার হরনি ও চানন্দী ইউনিয়নের নির্বাচন। নদীভাঙন ও সীমানা বিরোধের জটিলতায় দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর পর ভোট হতে যাচ্ছে এই দুটি ইউনিয়নে।
নির্বাচনি প্রচারে বাধা পাওয়ার অভিযোগ তুলে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে গেল ৩১ মে ‘কাফনের কাপড়’ জড়িয়ে এবং হাতে ‘বিষ’ নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন এ দুই ইউনিয়নের ২ জন চেয়ারম্যান ও ২৫ জন মেম্বার প্রার্থী।
এ অবস্থায় ১৫ জুনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফল করতে গেল ২ জুন সব প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন জেলা নির্বাচন কমিশনার। তবে এতে ভয় বা শঙ্কা তেমন কাটেনি ভোটারদের। তেমনি অভিযোগ আসাও বন্ধ হয়নি প্রার্থীদের।ভোটের আগে এলাকায় বহিরাগতদের জড়ো করে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, হুমকি দেয়া, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করাসহ নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসন বলছে, বহিরাগতদের ঠেকাতে ও ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছেন তারা।
সোমবার চানন্দী ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিরুল ইসলাম শামীম ও হরনি ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মুসফিকুর রহমান প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকতার কাছেও এ অভিযোগের অনুলিপি দিয়েছেন তারা।
অভিযোগে তারা উল্লেখ করেছেন, নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসের স্বামী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী তাদের ভোটের প্রচারে বাধা দিচ্ছেন, বহিরাগতদের জড়ো করে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এ ছাড়া পোলিং, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের হাতিয়া বাজারের ঈশিতা টাওয়ারে ডেকে নিয়ে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করার জন্য প্রভাবিত করছেন।
লিখিত অভিযোগে এ দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়মের অভিযোগও তোলেন।
ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে চানন্দী ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম নিউজবাংলাকে বলেন,‘শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে পারব কি না ভয়ে আছি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে শেষ পর্যন্ত কাজ করে ভোট মোটামুটি সুষ্ঠু হতে পারে।’
হরনি ইউনিয়নের ষাটোর্ধ্ব আহসান উল্লাহ বলেন, ‘সরকার ৩০ বছর পর এই ইউনিয়নে নির্বাচন ঘোষণা করেছে। এখন যেভাবে বহিরাগত লোকজন দেখা যাচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হয় কি না সন্দেহে আছি। মানুষ যেনো কেন্দ্রে যাইতে পারে, সে পরিবেশ করার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি।’
চানন্দী ইউনিয়নের ঢোল প্রতীকের আমিরুল ইসলাম শামীম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আমাকে বিভিন্ন বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যখন ভোটারদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়, তখন হাতিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আমাদের এলাকায় এসে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে ১৫ তারিখের পর এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হবে বলে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ভোটাররা এখন আতংকিত।
‘তাই বহিরাগতদের বের করে দিয়ে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তা ছাড়া নৌকার প্রার্থী (আজহার উদ্দিন) রঙিন ব্যানার ফেস্টুন লাগিয়ে ভোটের প্রচার চালাচ্ছে। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘন হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই।’প্রতিপক্ষের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আজহার উদ্দিন বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর এ অভিযোগ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হাতিয়া থেকে আমার প্রচারে অংশ নিতে আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্খিরা আসতেই পারেন। তারা তো অন্য উপজেলা থেকে আসেনি। ওরা নালিশ পার্টি। আজেবাজে কথা বলে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
হরনি ইউনিয়নের ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মুসফিকুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘কিছুদিন আগে মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মহোদয় সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু গত চারদিন থেকে বর্তমান এমপি সাহেবের স্বামী নির্বাচনি এলাকায় প্রচুর বহিরাগত লোকজন সমাগম করছেন।
‘তারা আমার নির্বাচনি অফিস বন্ধ করে দেয়। আমি নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি ওসি সাহেবকে তদন্ত করতে বলেন। কিন্তু ওসি সাহেব কোনো ব্যবস্থা নেননি। আজ পর্যন্ত আমার অফিস বন্ধ রয়েছে। তারা প্রকাশ্যে বলছেন, আঙ্গুলের টিপ দিলেই ভোট নিয়ে নিবে।’
স্বতন্ত্র এ প্রার্থী ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়েই এসব অভিযোগ তুলছেন বলে দাবি করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী ও ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আখতার হোসেন। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের মাঠে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হেরে যাওয়ার ভয়ে অযথা অভিযোগ করে নির্বাচনকে বিতর্কিত করছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে এসব কথা বলছে। এগুলো বাজে কথা, নোংরা কথা। আপনারা দেখেন কোনো বহিরাগত আছে কি না। তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনের সামনে বিষের বোতল আর কাফনের কাপড় নিয়ে গেছে, তাদের অভিযোগ তো আর বাকি নাই।’
জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে প্রার্থীরা অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু আমরা সবকিছুর বাস্তবতা পাই না। দলের সিনিয়র নেতা বা চেয়ারম্যানরা নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিতে পারে, আচরণবিধিতে কোনো বাধা নাই।
‘তবে কেউ যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে, তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরদারি করছেন।’
এলাকায় বহিরাগত আসার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেছে পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনি এলাকায় পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। যাদের সন্দেহ হচ্ছে, তারা এই এলাকার কি না জিজ্ঞাসাবাদ করছি। বহিরাগত আসার কোনো সুযোগ নাই।
‘আমার কাছে লিখিত কোনো অভিযোগ আসেনি, তবে মৌখিক অভিযোগ পাচ্ছি। যখন যে অভিযোগ পাচ্ছি আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি’ বলেন তিনি।