জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২২’ উত্থাপন করেন। এর মাধ্যমে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অতিরিক্ত ১৭ হাজার ৫২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমতি পেল।
তবে সম্পূরক বাজেট পাসের আগে এর বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সোমবার সংসদ অধিবেশনে সম্পূরক বাজেট অনুমোদনের জন্য ২৬টি মঞ্জুরি দাবির ওপর ২৩৮টি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে চারটির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। এগুলো হচ্ছে- জননিরাপত্তা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বাকি মঞ্জুরি দাবিগুলো সরাসরি ভোটে দেয়া হয়। অবশ্য সব ছাঁটাই প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অর্থমন্ত্রী ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২২’ উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
সম্পূরক বাজেটের আওতায় ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিপরীতে ১৭ হাজার ৫২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৫ হাজার ৩০৭ কোটি ৫৬ লাখ ৬১ হাজার টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগ খাতে বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে।
এর পরই রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়কে ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৩৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়। সবচেয়ে কম ১ কোটি ১৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বেশি বরাদ্দ পাওয়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ৫০০ কোটি ৬৯ লাখ ৬ হাজার, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ৭৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ৭৮ কোটি ২৫ লাখ ১৫ হাজার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ১১০ কোটি ৫৯ লাখ ৭১ হাজার, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ৪ কোটি ৮১ হাজার, আইন ও বিচার বিভাগ ৭ কোটি ৮১ লাখ ৮৫ হাজার, জননিরাপত্তা বিভাগে ১৭৮ কোটি ১৬ লাখ ২৯ হাজার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৯০৮ কোটি ৭১ লাখ ৯৮ হাজার, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খাত ২৫০ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৪৯৭ কোটি ৬২ লাখ ৯০ হাজার, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ৫২ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৮২ কোটি ৮৩ লাখ ৩২ হাজার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ১৪২ কোটি ৫৬ লাখ ৬২ হাজার, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৯১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৬ হাজার, শিল্প মন্ত্রণালয় ৬২৬ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাজার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১২ কোটি ৪২ লাখ ১৬ হাজার, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ১৪৭ কোটি ৮ লাখ ৫ হাজার, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৭৫৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ১৭২ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৫৪ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৩৫৩ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪০১ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
প্রসঙ্গত, সাংবিধানিক নিয়ম অনুসারে যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি তাদের হ্রাসকৃত বরাদ্দের জন্য সংসদের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে, কেবল তাদের বরাদ্দই সংসদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে এই সম্পূরক বাজেট পাস হয়।
সম্পূরক বাজেটের ওপর মোট ২৬টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ২৩৮টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়। ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী, রওশন আরা মান্নান ও পীর ফজলুর রহমান, বিএনপির হারুনুর রশীদ, মোশাররফ হোসেন ও রুমিন ফারহানা, গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমালোচনার পাশাপাশি সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ না দেয়ার দাবি জানান।
হারুনুর রশীদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নামের যে সংস্থাটি রয়েছে সেটিকে রাখার দরকার নেই। এটি বিলুপ্ত করে পুলিশ বাহিনীর হাতে দিয়ে দিলেই হবে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের রূপকল্প পর্যন্ত যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন থাকার দরকার নেই।
‘পুলিশ বিচার বিভাগের একটি অংশ। পুলিশ যখন সারা দেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী হয়, তখন নিঃসন্দেহে বোঝা যায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা কতটা নাজুক। পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অসত্য নয়। এই বিষয়গুলোর যদি সমাধান করতে না পারি তাহলে এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়াটা অপচয় ছাড়া আর কিছু না।’
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘এই সরকারের আমলে পুলিশ কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়, দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর এই বাহিনী দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও কৃষক লীগ নেতার মধ্যে আলোচনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে বলতে শোনা যায়- আমার তো সরকারি গুন্ডা আছে, আছে না? লাইসেন্সধারী। এটা বিরোধী দলের কাজ করবে নাকি আমি নির্দেশ দিলে তা বাস্তবায়ন করবে?’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা কোনো অন্যায় করলে পুলিশ চুপ থাকে। আমরা দেখতে পাই পুলিশ জনগণকে তাদের কর্মচারী মনে করে। মনে রাখতে হবে, দেশের মালিক জনগণ। আমরা সেই জনগণের প্রতিনিধি অর্থাৎ মালিকপক্ষের প্রতিনিধি। বাকি সবাই কর্মচারী, কেউ কর্মকর্তা নয়।’
রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী ভালো ও খারাপ দুটি কাজই করে থাকে। তবে খারাপ কাজে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা হলে এটা অনেকাংশে কমে আসবে।’