কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ প্রচারের মধ্যে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান একমাত্র কাঁটা, সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
ভোটের প্রচারে নামতে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের হয়ে কাজ করার অভিযোগ উঠার পর নির্বাচন কমিশন বাহারকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলেও তা মানেননি। এখনও নিজ এলাকাতেই অবস্থান করছেন তিনি।
নানা এলাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠার পর নির্বাচন কমিশন ছয়টি এলাকায় ভোট স্থগিত করে কঠোর মনোভাব দেখালেও বাহারের ক্ষেত্রে তারা কিছুই করতে পারছে না। এলাকা ছাড়ার চিঠি দেয়ার পর আর কোনো পদক্ষেপই নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন বাহারের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু, যিনি সিটি নির্বাচনে এর আগে দুই দফায় জয় পান।
সোমবার সকালে নগরীর নানুয়ার দিঘীরপাড়ে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের সাক্কু বলেন, ‘এমপি বাহার ইসির নির্দেশনা মানেননি। তিনি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতেই এলাকায় রয়েছেন। এখন দেখা যাক ইসি কী করতে পারে?’
২০১২ ও ২০১৭ সালে সিটি করপোরেশনের আগের দুই নির্বাচন চলাকালেও বাহার ছিলেন সংসদ সদস্য এবং তিনি এলাকাতেই অবস্থান করছিলেন। তবে সে সময় তার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি।
২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় দলটির প্রবীণ নেতা আফজল খানকে, যার সঙ্গে বাহারের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। বাহার ও আফজল নানা সময় একজন অন্যজনকে ভোটে হারাতে চেষ্টা করেছেন- এমন অভিযোগ ছিল।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ নৌকা তুলে দেয় আফজল কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমার হাতে। সে সময় বাহার বলয়ের নেতা-কর্মীরা ভোটে নৌকার পক্ষে কাজ করেনি বলে অভিযোগ ছিল।
এবার যার হাতে আওয়ামী লীগ নৌকা তুলে দিয়েছে, তিনি বাহারের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত। বরং আফজল বলয় এবার ভোটের বাইরে বলে আলোচনা আছে।
আফজল খান গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর তার বলয়ের প্রভাব অবশ্য কুমিল্লায় এখন তেমন দৃশ্যমান নয়।
বাহারের বিরুদ্ধে সাক্কুর কী অভিযোগ
ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে পরোক্ষভাবে নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক, দোকানমালিকসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষজনকে নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন।
গত ৬ জুন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন সাক্কু। অভিযোগে বলা হয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মহানগর দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবক ও আদর্শ সদর উপজেলার নেতাকর্মীদের একত্রিত করে সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পার্শ্ববর্তী সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলার নেতাকর্মীদের নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিয়ে সভা ও আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
যে কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীরা নির্বাচনি এলাকায় মোটরসাইকেল শোডাউনসহ নির্বাচনি সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। তেমনি সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ঠিক তেমনি আতঙ্কও সৃষ্টি করা হচ্ছে।
দুই দিন পর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাহারকে অবিলম্বে কুমিল্লা ছাড়ার অনুরোধ করে নির্বাচন কমিশন। ওই রাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিতও করেন। পরে তিনি সেই চিঠি পৌঁছে দেন বাহারের হাতে।
সংবাদ সম্মেলনে আসার ঘোষণা দিয়েও চুপ বাহার
নির্বাচন কমিশন চিঠি দেয়ার দিন বাহার নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসবেন। কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলন হয়নি। বারবার যোগাযোগ করেও তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। পরিচয় জানিয়ে এসএমএস করা হলেও সাড়া দেননি সদর আসনের সংসদ সদস্য।
বাহার কেন এলাকা ছাড়বেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খোকন। তিনি বলেন, ‘এমপি সাবের এলাকা সদর। সিটি করপোরেশনের বাইরে উনার ছয়টা ইউনিয়ন পরিষদ আছে। মানুষ আসে। বিভিন্ন কাজ থাকে। উনি এলাকা ছাড়লে মানুষের সেবা করবে কেমনে?
নির্বাচনের পরে আসবেন- এমন মন্তব্যে আতিক বলেন, ‘কেন পরে আসবেন? ইনি কি নৌকার জন্য কোথাও প্রচার-প্রচারণা করছেন? কেউ দেখছেন? উনি সিটি করপোরেশনের ভোটার। উনি কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর কেউ না যে উনি এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন।’
মুন্সেফবাড়ির বাসার কার্যালয়ে বসে বহিরাগতদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সাক্কুর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা আতিক উল্লাহ উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘তারা কি গিয়ে নিজের চোখে দেখেছেন, নাকি মানুষের মুখে শুনেছেন? উনাদের কাছে কোনো ভিডিও ফুটেজ আছে? যদি কোন প্রমাণ তারা দিতে পারেন, তাহলে মেনে নেব। আর যদি প্রমাণ দিতে না পারেন, তাহলে তারা মিথ্যা বলছে এটাই প্রমাণিত।’
ক্ষুব্ধ আরেক আলোচিত প্রার্থী কায়সারও
নির্বাচন কমিশনের আদেশ অমান্য করে বাহার এলাকায় অবস্থান করায় এই নির্বাচনে আলোচিত আরেক প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের নিজাম উদ্দিন কায়সারও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, উনি (বাহার) এলাকায় থেকে বহিরাগত নিয়ে মিটিং করেন। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের নির্বাচনের কাজ করতে বাধ্য করাচ্ছেন। ইসি কি এগুলো দেখে না? ইসি পারে শুধু আমাকে জরিমানা করতে। সমস্যা নাই। নগরবাসী আমার পাশে আছে।’
কায়সার জানান, এসব বিষয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সেখানে উল্লেখ করেছেন, বহিরাগত ক্যাডারের আনোগোনা বেড়েছে নগরে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তার মন্তব্য নেই
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে বাহারের এলাকায় অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের রিটানিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নাবী চৌধুরী মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে গতকাল আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্যার কথা বলেছেন। আমি আর কোন মন্তব্য করব না।’
কী বলছেন সিইসি
গত দুই দিন দুটি আয়োজনে কমিশনের আদেশ অমান্য করে বাহারের কুমিল্লায় অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
কুমিল্লার বাহারকে নিয়ন্ত্রণ করগে পারছেন না, জাতীয় নির্বাচনে এমপিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কি না- এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কি-না জানি না। কতগুলো বিষয় আছে উনাকে চিঠি দিয়েছিলাম যেন উনি এলাকায় না থাকেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচন যখন হবে, তখন তো তারা এলাকায় থাকবেন। উনারা সংসদীয় এলাকায় নির্বাচনী এলাকায় থাকবেন।
‘কিন্তু কিছু আচরণ ফলো করতে হবে। এই বিষয়টা তো আপেক্ষিক। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কি পারব না। সুতরাং আমাদের চেষ্টা থাকবে। এবং আমি আশা করি।'
এমপি বাহারের এখনও নিজ এলাকায় অবস্থানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল তিনি নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ করছেন৷ আচরণবিধি অনুযায়ী উনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। সে জন্য আমরা ওনাকে বলেছিলাম উনি যেন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ না নেন।
‘কিন্তু উনি আপিল করছেন এবং বাসায় অবস্থান করছেন৷ আইন অনুযায়ী উনি বাসায় অবস্থান করতে পারেন। বাসায় বসে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন, এটা প্রমাণ করা কঠিন। বিতর্ক যাতে না এজন্য আমরা বলেছিলাম, তিনি যেন এলাকা ছেড়ে চলে যান।
‘বাসা বসে যদি তিনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ না করেন; বাসায় থাকতে চান, থাকুক। ভোটের দিন তো উনি ভোটও দিতে পারবেন। বাসায় বসে নির্বাচনে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, এটা যারা অভিযোগ করবে তাদেরই প্রমাণ করতে হবে।’