আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে হুমকি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে সহিংসতায় স্থানীয় সরকারে আরও দুটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভায় ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
এ নিয়ে মোট ছয়টি এলাকায় এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলো, যার মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ এবং একটি পৌরসভা।
রোববার নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত আদেশে জানায়, আগামী ১৫ জুন টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার আরণখোলা ইউনিয়ন এবং বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নে ভোট হবে না।
একই দিন আরেক আদেশে ঝিনাইদহ পৌরসভায় ভোট স্থগিত করা হয়। সেখানেও ১৫ জুন ভোট হওয়ার কথা ছিল।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব পাওয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে। আইনের মধ্য থেকে কঠোর হয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার কথাও বলছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়া কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রথম পরীক্ষায় নামছে ১৫ জুন
কমিশনের প্রথম পরীক্ষা আগামী বুধবার। সেদিন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ছাড়াও ১৩৫টি ইউনিয়ন, ছয়টি পৌরসভা এবং একটি উপজেলায় ভোট হতে যাচ্ছে। ভোটের প্রচার চলাকালে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল, তাদের বিরুদ্ধে মামলার মতো পদক্ষেপে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যা দেশে বিরলই বলা যায়।
আরণখোলা ইউনিয়নে কী হয়েছিল
টাঙ্গাইল মধুপুর উপজেলার এই ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রহিমের পক্ষে প্রচারে অংশ নিয়ে একই উপজেলার মির্জাবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ছিল।
সাদিকুল প্রকাশ্যে বলেন, ‘নির্বাচনে নৌকায় যারা ভোট দিতে নারাজ, দয়া করে কেন্দ্রে আসবেন না। আমরা আশপাশেই অবস্থান করব। এখানে ২ হাজার ৪০০ ভোট রয়েছে, যদি দুই হাজার ভোট কাস্ট হয়, আমরা দুই হাজার ভোটই পেতে চাই।’
এই বক্তব্য বিভিন্ন পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এটি ইউনিয়ন পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ ও স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ এবং দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে কমিশনের আদেশে।
ভোট স্থগিতের পাশাপাশি সাদিকুলের বিরুদ্ধে মামলা করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কাজিরাবাদে কী হয়েছে
বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলাধীন কাজিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদে ভোট স্থগিতের পেছনে বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করা হয়নি নির্বাচন কমিশনের আদেশে।
বলা হয়েছে, ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সেখানে ভোট স্থগিত থাকবে।
আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি রুদ্র রোহান জানান, এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে সালাউদ্দিন সুমনকে। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল হোসেন স্থানীয় বিএনপি নেতা। তবে দল নির্বাচন বর্জন করায় প্রার্থী হয়েছেন স্বতন্ত্র হিসেবে।
গত শনিবার সেই এলাকায় কামাল সমর্থকদের ওপর নৌকা সমর্থকদের হামলার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে কামাল লিখিত অভিযোগ দেন নির্বাচন কমিশনে। প্রাথমিক তদন্তের পর ভোট স্থগিতের আদেশ দেয়া হয়।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কাজী শহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এক চিঠিতে কাজিরাবাদ ইউনিয়নের উপনির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। তবে কেন নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে, তার কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।’
স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি। নির্বাচনি মাঠে স্থানীয় প্রশাসন যদি কঠোর ভূমিকা পালন করত, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হতো না। ১৫ তারিখে নির্বাচন হলে আমি বিপুল ভোটে বিজয়ী হতাম।’
আগের আদেশও সরকারদলীয় প্রার্থীদের কারণে
দুই ইউনিয়নের বিষয়ে আদেশের পর ঝিনাইদহ পৌরসভায় ভোট স্থগিত করার আরও একটি আদেশ আসে। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল খালেকের অনুসারীরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করেছেন- এমন অভিযোগ ওঠার পর ২ জুন নৌকার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। ছয় দিন পর হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনের সেই আদেশ এক মাসের জন্য স্থগিত করার পর খালেক প্রচারে ফেরেন।
ঝিনাইদহ পৌরসভায় নৌকার প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের আদেশ হাইকোর্ট এক মাসের জন্য স্থগিতের পর ভোটও স্থগিত করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন
উচ্চ আদালতের এই আদেশের চতুর্থ দিনের মাথায় সেই এলাকায় ভোট স্থগিত করে দেয় নির্বাচন কমিশন। তারা জানায়, উচ্চ আদালতের আদেশ পালন করতে গেলে ভবিষ্যতে জটিলতা হতে পারে বলে এই আদেশ নেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে গোপন কক্ষে কর্মী রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে বাটন চেপে নিজের পক্ষে ভোট নেয়ার বিষয়ে নিজের পরিকল্পনা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। তার বক্তব্যের ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর সেটি আমলে নিয়ে গত ৫ জুন সেই ইউনিয়নে ভোট স্থগিত করে দেয়া হয়। পাশাপাশি মুজিবুলের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেয়া হয়।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী গোপন কক্ষে লোক রেখে ভোটারদের তার মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন
একই দিন স্থগিত করা হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ভোট। এক প্রার্থীর সই নকল করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অভিযোগ ছিল সেখানে। সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা ফিরে পেতে আবেদন করার পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে সত্যতা পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
গত ১৭ মে স্থগিত করা হয় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়নের ভোট। স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নেয়ামুল আকন অভিযোগ করেন, তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে দুর্বৃত্তরা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, তার এবং সঙ্গে থাকা স্ত্রীসহ পাঁচজনকে মারধর করে মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নেয়। সেদিনই ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ সময়।
বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ভোট স্থগিত করা হয়।
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়নে এক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে সেটি ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তাকে মারধর করা হয়
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকেও সতর্ক করেছে নির্বাচন কমিশন। আইন অমান্য করে তার হয়ে পরোক্ষভাবে ভোটের প্রচারে থাকায় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকেও সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাকে এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাহার অবশ্য এলাকা ছাড়েননি।
আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় আওয়ামী লীগের আরও তিনজন সংসদ সদস্যকে সাবধানও করে দিয়েছে কমিশন। এরা হলেন শরীয়তপুর-১ আসনের ইকবাল হাসান, ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও ঝিনাইদহ-১ আসনের মো. আব্দুল হাই।