যশোরের আলোচিত লাভলু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ। ভাই হত্যা মামলার তদারকি কিংবা স্ত্রীর বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক নয়, বরং ছিনতাই করা স্বর্ণের বার বিক্রির টাকা ভাগাভাগি নিয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদ্ঘাটন এবং এ ঘটনায় দুজনকে আটকের বিষয়টি রোববার নিশ্চিত করেছেন যশোর ডিবি পুলিশের ওসি রূপন কুমার সরকার।
গত ১০ জুন সকালে যশোর সদরের খোলাডাঙ্গা থেকে লাভলুর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত লাভলু ওই এলাকারই মধ্যপাড়া কলোনির আব্দুল মান্নানের ছেলে। তিনি আফিল গ্রুপে চাকরি করতেন।
ডিবি পুলিশের ওসি রূপন কুমার জানান, ছিনতাই করা স্বর্ণের বার বিক্রির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে খুন হয়েছেন লাভলু। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে খোলাডাঙ্গার কামরুজ্জামান ওরফে খোঁড়া কামরুলসহ তার কয়েক সহযোগী জড়িত। নিহত লাভলুর ছেলে শাকিল হোসেনও বিষয়টি জানতেন। ডিবি পুলিশ লাভলুর ছেলেসহ দুই আসামিকে ইতোমধ্যেই আটক করেছে।
লাভলুর ছেলে শাকিল ছাড়া আটক অন্য ব্যক্তি হলেন খোলাডাঙ্গা রেল কলোনির আব্দুর রশিদের ছেলে ইসরাইল।
ওসি রূপন কুমার আরও জানান, কামরুজ্জামান ওরফে খোঁড়া কামরুল ও তার সহযোগীরা কয়েক মাস আগে স্বর্ণ চোরাকারবারিদের কাছ থেকে ছয়-সাত কেজি স্বর্ণ ছিনতাই করে। লাভলুর ছেলে শাকিল ও স্বর্ণকার কবীরও খোঁড়া কামরুলের সহযোগী। ঘটনাচক্রে লাভলুও তাদের সহযোগী হয়ে যান।
ওই স্বর্ণ বিক্রি করে প্রতি বৃহস্পতিবার টাকা ভাগাভাগি করতেন তারা। গত বৃহস্পতিবারও ভাগবাটোয়ারার জন্য খোঁড়া কামরুল ও কবীরের ডাকে কামরুলের বাড়িতে যায় লাভলু ও তার ছেলে শাকিল। একপর্যায়ে শাকিল ঘরের বাইরে মোবাইলে গেম খেলতে গেলে তার বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন খোঁড়া কামরুল ও কবীর।
এ অবস্থায় রাত ১২টার দিকে হঠাৎ গুলির আওয়াজ শুনে শাকিল ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখেন, তার বাবা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। গুলিটি বুকে লাগায় প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই লাভলুর মৃত্যু হয়।
এ সময় খোঁড়া কামরুল, তার স্ত্রী, বোন এবং ঘটনাস্থলে থাকা কবীর ও রফিকুল শাকিলকে সান্ত্বনা দেয় এবং অর্থের লোভ দেখিয়ে হত্যাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার টোপ দেয়। পরে কামরুলের নির্দেশে কবীর ও রফিকুল মোটরসাইকেলে করে লাভলুর মরদেহ বেলতলা আমবাগানের মধ্যে ফেলে আসে। আর শাকিলকে অস্ত্র দিয়ে তা লুকিয়ে রাখতে বলে কামরুল।
এদিকে শুক্রবার সকালে পুলিশ লাভলুর লাশ উদ্ধার করে। ক্লুলেস এ হত্যার বিষয়ে প্রথমেই উঠে আসে ওই এলাকার লাভলুর প্রতিপক্ষের জড়িত থাকার বিষয়টি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, লাভলুর ভাই হত্যা মামলার আসামিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। একপর্যায়ে স্ত্রীর বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে লাভলুকে হত্যা করা হয়েছে বলেও গুঞ্জন ওঠে।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তের একপর্যায়ে লাভলুর ছেলে শাকিল ও স্ত্রী সালমাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে ডিবি পুলিশ। এ সময় শাকিল ঘটনা আড়াল করতে একেক সময় একেক তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন।
শেষ পর্যন্ত বাবার হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেন শাকিল। এ সময় তিনি মরদেহ গুম করার সময় ঘটনাস্থলে হত্যাকারীদের সঙ্গে উপস্থিত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে হত্যার বিস্তারিত জানান।
শাকিলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তার বাড়ির পাশের সদু পাগলের পুকুর থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলি ভর্তি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে খোঁড়া কামরুলের সহযোগী ইসরাইলকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকেও একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ।
এ ছাড়া ঘটনায় জড়িত প্রধান আসামি কামরুজ্জামান ওরফে খোঁড়া কামরুলকে ধরতে অভিযান শুরু হয়। বাড়িতে গিয়ে খোঁড়া কামরুল ও তার স্ত্রীকে না পেয়ে তালা ভেঙে শাকিলের দেয়া তথ্যের সত্যতা পায় ডিবি পুলিশ।
এ ঘটনায় লাভলুর বাবা আব্দুল মান্নান যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা ও ডিবি পুলিশের এসআই মফিজুর রহমান পৃথক দুটি অস্ত্র আইনে মামলা করেন। রোববার দুপুরে আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা হয়।