পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহম্মদ ইউনূসকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
সেতু উদ্বোধনের দুই সপ্তাহেরও কম সময় বাকি থাকতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ড. ইউনূসের কারণে এই সেতু নির্মাণে বিঘ্ন হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে এক দশক ধরে এই অভিযোগ করে আসার মধ্যে রোববার সেতু পরিদর্শন করে এই কথা জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আগামী ২৫ জুন জমকালো আয়োজনে দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটির উদ্বোধন করতে যাচ্ছে সরকার। এই সেতু উদ্বোধনের জন্য এসএসসি পরীক্ষাও এক দিন এগিয়ে আনা হয়েছে।
সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, যারা এই সেতু নির্মাণ নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলেছে, সরকারকে আক্রমণ করেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে। এবার ওবায়দুল কাদের জানালেন ড. ইউনূসের কথাও।
মন্ত্রী বলেন, ‘ইনভাইট? ইয়েস। উই উইল ইনভাইট অল। সবাইকে ইনভাইট করব। আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, প্রফেসর ইউনূস থেকে শুরু করে বেগম খালেদা জিয়া… বিরোধিতার ব্যাপার না, আমরা এ দেশে যতটুকু সম্ভব সরকারি, বেসরকারি, বিরোধী সবাইকে আমরা আমন্ত্রণ করার চিন্তাভাবনা করছি। নেত্রী সেভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন।’
আমন্ত্রণ জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রক্রিয়া প্রায় শেষ।’
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজনের চিঠি ছাপানোর কাজ শেষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বুধ-বৃহস্পতিবার থেকে কার্ড বিতরণ শুরু হবে।’
ড. ইউনূস অবশ্য দেশে নেই। গত কয়েক বছর ধরে তিনি বেশির ভাগ সময়ই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
বিদেশি অতিথিদের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। বলেন, ‘ফরেইন অফিসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। চিঠি তারা পেয়ে যাবে। অ্যাকরডিংলি তারা যাদের কাছে চিঠি পাঠানো দরকার, তাদের পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পর্কে এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের জানান, সেদিন মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন শেখ হাসিনা। বক্তব্য রাখবেন সুধী সমাবেশে।
এরপর ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ছয় মিনিটে ওপারে নদীর অপর প্রান্তে। সেখানে জাজিরা প্রান্তে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দেবেন ভাষণ।
ড. ইউনূসকে নিয়ে কী অভিযোগ
পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার শুরু থেকেই তুমুল আলোচনা হচ্ছে। প্রথমে সেতুর অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ যোগাযোগ করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে। পাশাপাশি আইডিবি, এডিবি ও জাইকারও কিছু সহযোগিতা থাকার কথা ছিল।
তবে সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক নানা বক্তব্য দেয়ার পর ২০১৩ সালে এই সেতু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
শুরু থেকেই সরকার এই অভিযোগকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে আসছিল। দাতারা সেতু থেকে সরে যাওয়ার পর অভিযোগ করা হয়, সংস্থাটির এই সিদ্ধান্তের পেছনে ড. ইউনূসের হাত আছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পদ ছাড়তে বলা হয় তার বয়স ৬০ অতিক্রম করায়। তবে তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফোন করে ইউনূসের পক্ষে সুপারিশ করেন বলে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
সরকারের অভিযোগ, সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তদবির করিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করানো হয়।
গত ১৮ মে আওয়ামী লীগের এক আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তর বক্তব্য রাখেন সরকারপ্রধান।
সেদিন তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করাল ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটা এমডির পদে তাকে থাকতে হবে। তাকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, গ্রামীণ ব্যাংকের উপদেষ্টা হতে, ইমেরিটাস উপদেষ্টা হিসেবে থাকার জন্য, আরও উচ্চ মানের। কিন্তু সেখানে সে থাকবে না। তার এমডিই থাকতে হবে। কিন্তু তার বয়সে কুলায় না।
‘ড. ইউনূস কিন্তু আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল। কিন্তু কোর্ট আর যাই পারুক, তার বয়স তো কমিয়ে দিতে পারবে না ১০ বছর। কারণ গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে আছে ৬০ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তখন তার বয়স ৭১ বছর। বয়সটা কমাবে কীভাবে। মামলায় সে হেরে যায়।’
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের হাত ছিল বলেও সেদিন অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘প্রতিহিংসা নেয় ড. ইউনূস এবং যেটা আমরা শুনেছি মাহফুজ আনাম। তারা আমেরিকায় চলে যায়, স্টেট ডিপার্টমেন্টে যায়। হিলারির কাছে ই-মেইল পাঠায়। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিস্টার জোয়েলিক তার শেষ কর্মদিবসে কোনো বোর্ডসভায় না, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।’
সেদিন ড. ইউনূসকে পদ্মা নদীতে নিয়ে চুবনি দেয়ার কথাও বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যিনি (ড. ইউনূস) এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো টাকা বন্ধ করেছেন, তাকেও আবার পদ্মা নদীতে নিয়ে দুটি চুবনি দিয়ে উঠিয়ে নেয়া উচিত, মরে যাতে না যায়। পদ্মা নদীতে দুটি চুবনি দিয়ে সেতুতে উঠিয়া নেয়া উচিত। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়।’
এই বক্তব্যের পরদিন মাহফুজ আনাম অবশ্য তার পত্রিকায় একটি বক্তব্য ছাপান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, আমি এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কখনো যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাইনি, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাইনি, কখনও হিলারি ক্লিনটনকে কোনো ই-মেইল পাঠাইনি, ওয়াশিংটনে বা বিশ্বের অন্য কোনো জায়গায় বা শহরে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কোনো বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক বা যোগাযোগ করিনি। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, আমার বিষয়ে করা মন্তব্য তথ্যভিত্তিক নয়।’
তবে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে যা হয়েছিল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে যখন উদ্যোগ নেয়, তখন ঋণচুক্তি করা হয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবির সঙ্গে। তবে সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ তুলে একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে অন্যরাও এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
এই ঘটনায় সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানিয়ে এই ব্যবস্থায় রাজি হয়নি।
পরে বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে এসএনসি লাভালিন নামে দেশটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
সেতুর কাজ শুরুর দুই বছর পর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কানাডার আদালত রায় দেয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ বায়বীয়, গালগপ্প।
সে সময় কানাডার পত্রিকা টরন্টো স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, রায়ের আদেশে বিচারক লেখেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই না। কানাডার সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নর্দেইমার এ রায় দেন।