পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগের শুরুতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়িয়ে যে অপমান করা হয়েছিল, এই স্থাপনাকে সেই অপমানের ‘প্রতিশোধের প্রতীক’ উল্লেখ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আগামী ২৫ জুন এই সেতু উদ্বোধনের দিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রোববার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর সার্ভিস এরিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই সেতু আমাদের সামর্থ্য, সক্ষমতার সেতু। এই সেতু একদিকে সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। অন্যদিকে আমাদেরকে যে অপমান করা হয়েছিল সে অপমানের প্রতিশোধের প্রতীক।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিশ্বব্যাংক এই সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে এই সেতুর কৃতিত্ব আসলে তারই।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ছবি: নিউজবাংলাতিনি মন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে আর কারও কোনো কৃতিত্ব নেই। আমরা শুধু তার নির্দেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। যারা অপবাদ দিয়েছেন, এই সেতু নির্মাণ করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমরা বীরের জাতি। আমরা দুর্নীতি করি না।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে যখন উদ্যোগ নেয়, তখন ঋণচুক্তি করা হয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবির সঙ্গে। তবে সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ তুলে এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক সরে গেলে অন্যরাও এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
শুরু থেকেই সরকার এই অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে এসে বলতে থাকে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে বেআইনিভাবে ড. ইউনূসকে রাখতে রাজি না হওয়ায় বিশ্বব্যাংককে দিয়ে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এই ঘটনায় সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানিয়ে এই ব্যবস্থায় রাজি হয়নি।
পরে বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে এসএনসি লাভালিন নামে দেশটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই প্রতিষ্ঠানটিই পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাওয়ার কথা ছিল। তবে সেই মামলা টেকেনি, দেশটির একটি আদালতে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে ‘গালগপ্প’ বলে উড়িয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাংকের সে সময়ের ভূমিকার কথা তুলে আক্ষেপ করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনাকে একা নয়, একটা ফ্যামিলিকে, গোটা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে টার্গেট করা হয়। আমি মন্ত্রী, আমার রুমে বসে অফিসে মন্ত্রণালয়ে বিশ্ব ব্যাংকের পাকিস্তানি ডিরেক্টর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির দিকে তাকিয়ে আমাকে বলছে ‘দিজ লেডি ইজ দ্যা মোস্ট করাপ্ট উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। এ ধরনের অপমানজনক বক্তব্য তারা তখন বলেছিল’।
‘শেখ রেহানাকেও ছাড়েনি। জয়কে, পুতুলকে, ববিকে--গোটা পরিবারকে অপমানিত করল। সেজন্য আমরা বলছি, বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর বীর কন্যা শেখ হাসিনা তিনি সেদিন জোর গলায় বলেছিলেন, সংসদে ভাষণ দিয়েছিলেন, আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করব, সেদিন আমাদের আশেপাশে অনেকই ছিল না। অনেককেই বিদ্রূপ করতে শুনেছি। এটা কি সম্ভব বিশ্ব ব্যাংক ছাড়া? শেখ হাসিনা বললেই হবে নাকি? কীভাবে হবে, কোথায় পাবে টাকা--এসব কথা আমাদের সহ্য করতে হয়েছে পদ্মা সেতুর জন্য।’
আমন্ত্রণ পাচ্ছেন ড. ইউনূসও
ড. ইউনূসের কারণে এই সেতু নির্মাণে বিঘ্ন হওয়ার অভিযোগ তুললেও তাকেও সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর কথা জানান কাদের। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ড. ইউনূস, বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধীদের আমরা আমন্ত্রণ জানাব। এটা নেত্রীর সিদ্ধান্ত।’
বিদেশি অতিথিদের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজনের চিঠি ছাপানো শেষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বুধ বৃহস্পতিবার থেকে বিতরণ শুরু হবে।’
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্পর্কে এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের জানান, সেদিন মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন শেখ হাসিনা। বক্তব্য রাখেবেন সুধী সমাবেশে।
এরপর ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ছয় মিনিটে ওপারে নদীর অপর প্রান্তে। সেখানে জাজিরাপ্রান্তে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। এরপর কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দেবেন ভাষণ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কোনো নাশকতা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে এই অগ্নিকাণ্ডগুলো, বিভিন্ন জায়গায় এটি কি এমনি হচ্ছে, নাকি অন্য কেউ করাচ্ছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে সামনে রেখে এ ধরনের অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা আমাদের আছে। আমাদের আগেও ছিল, এখনও এই আশঙ্কায় আমরা আছি। কাজেই এটা তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের মাধ্যমে অন্তর্ঘাত আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
৩৫ বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা শোধ করতে হবে
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এ সেতু তৈরি করেছে। আগামী ৩৫ বছরে সরকারকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।’
এই সেতু দিয়ে যাতায়াতের জন্য যে এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে, তাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত বিভিন্নখাতে টোল আদায় নিয়েও কথা বলেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা চিন্তা ভাবনা করছি। জনগণের জন্য যে সেতু সেই সেতুকে জনগণের ওপর বোঝা হিসেবে আমরা উপহার দিতে চাই না।‘
দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলার গাড়ি যখন একসঙ্গে ঢাকায় ঢোকা শুরু হবে, তখন যে চাপ ঢাকার ওপর তৈরি হবে, সেটা নিয়ন্ত্রণে সরকার কী ভাবছে- এমন প্রশ্ন রাখা হয় ওবায়দুল কাদেরের কাছে।
তিনি বলেন, ‘দেখুন এসব অনেক ভাবনা চিন্তা আমাদের আছে। সংশয় ছিল পদ্মা সেতু হবে কী হবে না। সেটা যখন পেরেছি, এইসব চাপও আমরা ইনশাআল্লাহ মোকাবিলা করতে পারব।‘