সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণে অন্তত ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ।
প্রায় ৮৭ ঘণ্টা জ্বালিয়ে বুধবার দুপুরের দিকে নেভে কনটেইনার ডিপোর আগুন।
আগুন-বিস্ফোরণের মাত্রা কেন এতটা ভয়াবহ হলো সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে নিউজবাংলা।
ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে রপ্তানির উদ্দেশ্যে ডিপোতে কনটেইনারে মজুত থাকা বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে ফায়ার সার্ভিস। তারা বলছে, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আগুনের তাপের সংস্পর্শে আসায় ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধান বলছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছাড়াও অন্য কোনো রাসায়নিকের মজুত থাকতে পারে। প্রথম দিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সেই রাসায়নিককে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ওই রাসায়নিকের কারণে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম দলটি অপেক্ষাকৃত ছোট মাত্রার আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়। পরে আগুনের তাপ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কনটেইনার পর্যন্ত পৌঁছালে ধারাবাহিকভাবে ছোট-মাঝারি ও বড় অন্তত ১০টি বিস্ফোরণ ঘটে।
একাধিক ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে আগুন লাগার শুরুর দিকের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, শনিবার ডিপোর শেডে একটি কনটেইনার থেকে তুলা আনলোড করা হচ্ছিল। এর বাম দিকে প্রায় ৫০০ ফুট দূরে শেডের মাঝ বরাবর পাশাপাশি ও একটার ওপর আরেকটি এভাবে ৩৭টি কনটেইনার আলাদা করে রাখা ছিল। বেশ কয়েক দিন আগে ডিপোতে আনা এসব কনটেইনারে রপ্তানির উদ্দেশ্যে রাসায়নিক মজুত করা ছিল।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন কাভার্ড ভ্যানচালক পাশের ৩৭টি কনটেইনারের মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাম দিক থেকে দ্বিতীয় কনটেইনারের ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন। তারা ডিপোর নিরাপত্তাকর্মীদের বিষয়টি জানান।
ডিপোতে আগুন লাগা থেকে বিস্ফোরণ ঘটা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন কাভার্ড ভ্যানচালক আলী আহমেদ। বিস্ফোরণে তিনি নিজেও আহত হন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম দুপুর ১২টায়। মূলত ঢাকা থেকে রপ্তানির জন্য তৈরি পোশাক নিয়ে গিয়েছিলাম ওই দিন। ডিপোর উত্তর দিকে সন্ধ্যা ৭টা বা সাড়ে ৭টার দিকে একটি কনটেইনার থেকে প্রথম ধোঁয়া উঠতে দেখি।
‘নিরাপত্তারক্ষীদের জানালে তারা বলল, মাঝে মাঝেই এমন হয়। এসব কিছু না। এগুলো এমনিতেই নিভে যায়।’
আলী আহমেদ জানান, তবে আগুন হঠাৎ বাড়তে শুরু করলে সবার টনক নড়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিপোর কর্মচারীরা ধোঁয়ার সঙ্গে কনটেইনারের ভেতরে আগুনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে রাত ৯টার দিকে জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন ৯৯৯-এ ফোন করেন। পরে পুলিশ পাশের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে খবর দেয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ডিপোতে পৌঁছায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফায়ার ফাইটাররা কিছুক্ষণ কনটেইনারের আগুনের ধরন যাচাই, কনটেইনারে মজুত পণ্য এবং আশপাশে পানির উৎস খোঁজায় কিছুটা সময় ব্যয় করে রাত ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। ততক্ষণে প্রায় ৭০০ ফুট দূরের শেড থেকে কনটেইনারের আগুন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
প্রথমে দুটি হোসপাইপ দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কনটেইনারের ভেতরের আগুনে পানি দিতে শুরু করেন। এর ৫ মিনিটের মধ্যে ছোট ছোট তিনটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে আগুন আরও উসকে ওঠে। ঘটনাস্থল থেকে মোবাইল ফোনে করা লাইভের ভিডিও বিশ্লেষণ করেও এসব ছোট বিস্ফোরণ শনাক্ত করা গেছে।
এ পর্যায়ে আগুন ধীরে ধীরে পাশের ও ওপরের অন্য রাসায়নিকের কনটেইনারেও ছড়াতে শুরু করে।
এরই মধ্যে ক্রেনের সাহায্যে ওপর থেকে কয়েকটি কনটেইনার সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় ডিপো কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দুটি গাড়ি সামনে এনে সেগুলোর মাধ্যমে আগুনে পানি ছিটাতে শুরু করেন। এর মাঝে আরও কয়েক দফা ছোট ও মাঝারি বিস্ফোরণ ঘটে।
বিস্ফোরণের আগের দিন রাত থেকে ডিপোতে ছিলেন ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পুলিশ রেজ্জাক মণ্ডল। তিনিও বিস্ফোরণে আহত হন।
রেজ্জাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগুন লেগেছিল কেমিক্যালের কনটেইনারে। একটার ওপর আরেকটা কনটেইনার ছিল। সেগুলো সরানোয় আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের সময় পানির মতো কেমিক্যাল আমাদের শরীরে এসে পড়ে। যেখানে যেখানে লেগেছে সেখানেই পুড়ে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। গেটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা দেয়াল টপকে বের হয়েছি অনেক কষ্টে।’
রাত পৌনে ১১টার দিকে বিকট বিস্ফোরণে পুরো ডিপোতে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। এই বিস্ফোরণেই হতাহতসহ পুরো ডিপো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
পরদিন সকালে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ডিপোতে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মজুত ছিল। আর এই রাসায়নিক সম্পর্কে ডিপো কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে অবহিত করেনি। উচ্চ তাপে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন নির্গত হয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস আগুনের সূত্রপাত ও প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে না আসার বিষয়ে এখনও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
তবে রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উচ্চ তাপ ও আগুনের সংস্পর্শে এসে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বিস্ফোরকের মতো আচরণ করলেও প্রথম কনটেইনারে আগুনের উৎস ছিল অন্য কোনো রাসায়নিক।
তারা বলছেন, হাইড্রোজনের পার-অক্সাইড (H2O2) বিশুদ্ধ অবস্থায় একটি বর্ণহীন তরল। উচ্চ তাপমাত্রায় এটি আগুন ছড়াতে সহায়ক হলেও নিজে জ্বলতে পারে না। অর্থাৎ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডে আগুন জ্বলবে না। তবে উচ্চ তাপ ও আগুনের সংস্পর্শে এলে এই রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আগুন জ্বালাতে পারে না। অথচ আমরা বিভিন্ন ফুটেজে দেখলাম, কনটেইনারে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তারপর সেটা ব্লাস্ট করেছে।
‘তাহলে প্রথমে কনটেইনারে আগুনটা শুরু হলো কীভাবে, সে প্রশ্ন এসেই যায়। ওই কনটেইনারে আগুন জ্বালানোর জন্য অন্য একটি দাহ্য রাসায়নিকের উপস্থিতি ছিল, যা কি না প্রথমে আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ পুড়িয়েছে। পরে সেটার তাপে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে বিস্ফোরকের ভূমিকায় দেখা গেছে।’
একই ধরনের মত দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোফাজ্জল হোসেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু অন্য কোনো আগুনের সোর্স পাওয়া যায়নি, তাহলে ওই কনটেইনারে নিশ্চিতভাবে একটি আগুন জ্বালানোর কেমিক্যাল থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে বড় প্রশ্ন আগুনটা জ্বালালো কে? আমরা যদি দেখতাম- কোনো গার্মেন্টসের কনটেইনারে আগুন লেগে পরে তা কেমিক্যালের কনটেইনারে ছড়িয়েছে, তাহলে এ প্রশ্ন তোলার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
‘যেহেতু হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে আগুন জ্বালাতে পারে না, তাহলে হয়তো ওই কনটেইনারে অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ ছিল। সেটা কোনো কারণে লিক করে কনটেইনারে বা এর বাইরেও ছড়িয়েছে। পরে কেউ ওই কনটেইনারের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো বা অন্য কোনো উপায়ে ছোট একটা স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত হলো। এরপর যা ঘটেছে তার জন্য হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে দোষারোপ করাই যায়।’
ডিপোতে মজুত থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। তাদের নীল রঙের প্রতিটি গ্যালনের গায়ে স্টিকারে লেখা আছে, ৬০ শতাংশ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড- মেডিক্যালে ব্যবহারে প্রযোজ্য নয়, ওজন ৩০ কেজি। সতর্কীকরণে বলা হয়েছে, এই রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে আগুন ছড়াতে পারে, উচ্চতাপে বিস্ফোরিত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিস্ফোরণ ও আগুনে যেখানে ডিপোর অনেক কনটেইনার ও শেড পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সেখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের গ্যালনগুলোর বেশির ভাগই পোড়েনি। শুধু বিস্ফোরণে সেগুলো ফেঁটে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বেরিয়ে গেছে। এই রাসায়নিক আগুন জ্বালাতে পারলে গ্যালনগুলোও পুড়ে যেত।
আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ও বিএম কনটেইনার ডিপো দুটিই স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সঙ্গে ডিপোতে অন্য কোনো রাসায়নিকের কনটেইনার ছিল কি না জানতে চাইলে স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বুধবার নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, সেখানে রপ্তানির উদ্দেশ্যে শুধু হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কনটেইনারবন্দি অবস্থায় ছিল। প্রতিটি কনটেইনারে ২০ টন করে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মোট ৩৭টি কনটেইনার ছিল। অন্য কোনো রাসায়নিক তাদের কনটেইনারে ছিল না।
তবে ডিপোতে অন্য রাসায়নিক থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেখানে অন্যদেরও কনটেইনার ছিল। সেসব কনটেইনারে অনুমতি ছাড়া অন্য পণ্যের আড়ালে কোনো কেমিক্যাল ছিল কি না আমাদের জানা নেই।
‘আমাদের দেশে তো নিয়মের বাইরে অনেক কিছুই হয়। ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছাড়া অন্য কোনো কেমিক্যাল ছিল কি না তা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখতে তদন্ত কমিটিকে আমরা অনুরোধ করেছি।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘তদন্তের স্বার্থে’ ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ও তদন্ত কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে তিনি জানান, সব কিছু মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে, ডিপোতে অন্য কোনো রাসায়নিক থাকলে তদন্তে বেরিয়ে আসবে।