৫ জুন শনিবার রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর অনেকেই ঘটনাস্থল থেকে ফেসবুকে তা লাইভ করেন। এমন তিনটি ফুটেজ নিউজবাংলার হাতে এসেছে।
এর মধ্যে ৪২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে ঘটনার সময় ডিপোর ভেতরে শতাধিক মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। কে ধারণ করেছেন তা জানা না গেলেও ভিডিওটি বিএম কনটেইনার ডিপোর বলে নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন বিস্ফোরণে আহত একাধিক ব্যক্তি।
ভিডিওটিতে ২ মিনিট ৪ সেকেন্ডে অগ্নিকাণ্ডের স্থলে রাসায়নিক পণ্যের উপস্থিতির কথা বলতে শোনা যায় একজনকে।
ভিডিওটিতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়। ৪ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের দিকে উৎসুক সাধারণ মানুষকে পুলিশের ধাওয়া দিতে দেখা গেছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও মানুষের ভিড় বেড়ে যায়।
১৯ মিনিট ০১ সেকেন্ডে ভিডিও ধারণকারীদের মধ্যে একজন মন্তব্য করেন ‘দোজখের আগুনের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতেছে।’ এর ১৩ সেকেন্ড পরই প্রথম বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
সঙ্গে সঙ্গে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। একই সময়ে ৩ থেকে ৪টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। প্রথম বড় বিস্ফোরণের ৫০ সেকেন্ড পর উচ্চ স্বরে একাধিক মানুষকে কলেমা পড়তে শোনা গেছে। এ সময় আহত অনেকের আর্তনাদও শোনা যায়।
এক মিনিট পর আল্লাহ আল্লাহ বলে শব্দ করেন আরেকজন। ২১ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকেন আরেকজন।
প্রায় ১০ মিনিট পর আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় ভিডিওতে। তখন স্ক্রিন কালো থেকে লাল-হলুদাভ হতে শুরু করে ভিডিওর। ৩৪ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে পুনরায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
অন্য দুটি ভিডিওর একটি সংগ্রহ করা হয়েছে অলিউর রহমান নয়ন নামের এক কিশোরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। বিস্ফোরণের পরদিন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনরা। তার ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়া ভিডিওটি ছিল ৪৫ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের।
এই ভিডিও শুরুর ৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এগুলো সব কেমিক্যালের কনটেইনার।’
বিশ সেকেন্ড পর ঘটনাস্থলে শতাধিক মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। তাদের অধিকাংশই ফোনে ভিডিও ধারণ করছিলেন।
ভিডিওর ১২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে কনটেইনারের ভেতরে প্রথম ছোট একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর এক মিনিট পর ছোট ছোট আরও ৪টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তখন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মাইকিং করে সবাইকে সরে যেতে অনুরোধ করা হয়।
ভিডিওর ১৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে। এটি আগের বিস্ফোরণের চেয়ে বেশি মাত্রার ছিল। এর পরই মূলত আগুন বাড়তে শুরু করে। ২২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে ফের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর এক মিনিট ১০ সেকেন্ড পর আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে।
এরপর ছোট ছোট বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি দেখা গেলেও পরে দুটি গাড়িকে আগুন নেভাতে দেখা যায়।
৪০ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের দিকে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণটি ঘটে। এ সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। মানুষের আর্তনাদের শব্দ শোনা যায়।
তৃতীয় ভিডিওটি মাঈনউদ্দিন নামের আরেক কিশোরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নেয়া। ঘটনার সময় সেও ফেসবুকে লাইভ করছিল। তার লাইভের ১১ মিনিট ১২ সেকেন্ডের সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পর থেকে তার খোঁজ পায়নি পরিবার।
সেদিন রাতে আগুন লাগা থেকে বিস্ফোরণ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন কাভার্ড ভ্যানচালক আলী আহমেদ। বিস্ফোরণে তিনি নিজেও আহত হন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম দুপুর ১২টায়। মূলত ঢাকা থেকে রপ্তানির জন্য তৈরি পোশাক নিয়ে গিয়েছিলাম ওই দিন। ডিপোর উত্তর দিকে সন্ধ্যা ৭টা বা সাড়ে ৭টার দিকে একটি কনটেইনার থেকে প্রথম ধোঁয়া উঠতে দেখি আমি।
‘নিরাপত্তারক্ষীদের জানালে তারা বলল, মাঝে মাঝেই এমন হয়। এসব কিছু না। এগুলো এমনিতেই নিভে যায়।’
আলী আহমেদ জানান, আগুন হঠাৎ বাড়তে শুরু করলে সবার টনক নড়ে। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাইকে জানায়। ফায়ার সার্ভিসকেও জানানো হয়। এক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি আসে। কিন্তু তাদের পানি শেষ হয়ে যায়। আধাঘণ্টা পর আসে আরেকটি গাড়ি। রাত পৌনে ১১টার দিকে বড় বিস্ফোরণটি ঘটে।
বিস্ফোরণের আগের দিন রাত থেকে ডিপোতে ছিলেন ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পুলিশ রেজ্জাক মণ্ডল। তিনিও বিস্ফোরণে আহত হন।
রেজ্জাক বলেন, ‘আগুন লেগেছিল কেমিক্যালের কনটেইনারে। একটার ওপর আরেকটা কনটেইনার ছিল। সেগুলো সরানোতে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের সময় পানির মতো কেমিক্যাল আমাদের শরীরে এসে পড়ে। যেখানে যেখানে লেগেছে সেখানেই পুড়ে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। গেটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা দেয়াল টপকে বের হয়েছি অনেক কষ্টে।’
ঘটনার সময় ডিপোতে ফোরম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন রাজু হাসান। বিস্ফোরণে দগ্ধ রাজু বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি সবাইকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তারা সরেনি। যারা সরেছে, তারা বেঁচে গেছে। না হলে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ত।’
আগুনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে পরোক্ষভাবে রাসায়নিকের কনটেইনার থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে জানান রাজু।
শনিবার রাতে বিস্ফোরণের সময় কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ১৫ সদস্য ঘটনাস্থলে ছিলেন। এর মধ্যে ৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ তিনজন। দুজন ঢাকায় চিকিৎসাধীন। অক্ষত ছিলেন রাকিব হাসান বাপ্পি।
নিউজবাংলাকে বাপ্পি বলেন, ‘গণমাধ্যমে বয়ান দেয়ার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। কনটেইনারে রাসায়নিক ছিল, কিন্তু আমরা জানতাম না। মানে আমাদের জানানো হয়নি। আমার এক স্যার আমাকে মেসেজ দিয়েছিলেন, পাম্পে যেতে। আমি গিয়েছিলাম।
‘সে সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শারীরিকভাবে আমার খুব বেশি সমস্যা হয়নি। কানে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে আমার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ এখন।’