সিলেটের জৈন্তাপুরে অপহরণ চক্র নিয়ে ফেসবুকে ওসির সতকর্তার পোস্টকে পুলিশের অসহায়ত্বের প্রকাশ হিসেবে দেখছেন আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতারা। ওই পোস্ট দেখার পর থেকে এলাকায় আতঙ্কও বেড়েছে।
তবে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, পুলিশ ওই চক্রকে ধরতে সচেষ্ট ও তৎপর। ওই পোস্ট কেবলই সতর্ক করার জন্য, ভয়ের কোনো কারণ নেই।
‘ওসি জৈন্তাপুর সিলেট’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে মঙ্গলবার ওই পোস্ট দিয়েছেন থানার ওসি গোলাম দস্তগীর গাজী।
তাতে লেখা হয়েছে, ‘একটি অপহরনকারী চক্র জৈন্তাপুর থানা এলাকায় অবস্থান করতেছে। পুরুষ ও মহিলা নিয়ে চক্রটি গঠিত। তাদের টার্গেট স্কুল / কলেজের মেয়েদের অপহরণ করে পাচার করে দেওয়া। এমতাবস্থায় স্কুল /কলেজের সম্মানিত শিক্ষকগনকে এই ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের সতর্কত করার অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী স্কুল /কলেজেগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের পুলিশিং তৎপরতা অব্যাহত আছে। এই ব্যাপারে জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য জৈন্তাপুরবাসীকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ (মূল পোস্টে বানান অপরিবর্তীত)।
এ বিষয়ে আইনজীবী দেবব্রত চৌধুরী লিটন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজই হচ্ছে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো এলাকায় যদি অপরাধ বেড়ে যায় তাহলে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবেই ধরা হয়।
‘জৈন্তাপুরে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ এর সঙ্গে জড়িতদের এখন পর্যন্ত ধরতে পারেনি। উল্টো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ওসি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন। ওসির এমন স্ট্যাটাসে পুলিশের অসহায়ত্বই প্রকাশ পাচ্ছে। একইসঙ্গে মানুষজনও এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে।’
তবে ওসি গোলাম দস্তগীর জানিয়েছেন, মানুষকে সচেতন করতে এই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অপহরণকারীদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেউ যেন আতঙ্কিত না হন সেই প্রচারও আমরা চালাচ্ছি। পুলিশ তার কাজ করছে। মানুষকে সচেতন করাও আমাদের কাজ। মানুষ সচেতন হলে অপরাধ অনেকটা কমে আসে। পুলিশের কাজ তখন অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তাই মানুষকে সচেতন করতেই এমন স্ট্যাটাস দিয়েছি।’
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. লুৎফুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অপহরণকারীদের ধরতে আজ থেকে পোষাকে ও সাদা পোষাকে আমাদের সাতটি টিম জৈন্তাপুরে কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওই উপজেলায় অপহরণের একাধিক অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আমাদের গোয়েন্দা টিমও মাঠে কাজ করছে।’
ওসির স্ট্যাটাসে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই স্ট্যাটাস আমিও দেখেছি। মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যেই এটি দেয়া হয়েছে। এতে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। পুলিশ যে অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে, সেটিও স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন ওসি। ফলে ওই স্ট্যাটাস পড়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
তবে উদ্দেশ্য মানুষকে সচেতন করা হলেও এমন স্ট্যাটাসে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মত জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শাহেদ আহমদের।
তিনি বলেন, ‘তার (ওসির) উদ্দেশ্য খারাপ নয়। তবে এতে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটায় এলাকায় এমনিতেই আতঙ্ক রয়েছে। ওসির এই স্ট্যাটাসে আতঙ্ক আরও বেড়ে যেতে পারে।’
শাহেদের আশঙ্কার সত্যতাও পাওয়া গেল কয়েক অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করে।
জৈন্তাপুরের হরিপুর এলাকার নেছার আহমদ বলেন, ‘আমার একটি মেয়ে স্কুলে পড়ে। এলাকায় শুনেছি অপহণকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। পুলিশ ফেসবুকে এমনটি জানিয়েছে। ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাস দেখার পর থেকে মেয়েকে নিয়ে ভয়ে আছি। তাকে স্কুলে একা ছাড়তে ভয় করছে।’
উপজেলার ফতেহপুর এলাকার আতাউর রহমানের মেয়ে স্থানীয় স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
ওসির ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ার পর থেকেই ভয়ে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অপহরণকারীচক্র নিশ্চয়ই খুব দক্ষ। তাই পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না। না পেরে ফেসবুকে সবাইকে সতর্ক থাকার কথা বলেছে।
‘মেয়ের স্কুল তো বন্ধ করা যাবে না। তবে এখন আর একা স্কুলে ছাড়ি না। নিজে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করি।’
ওসির ওই স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টবক্সে অনেকেই সচেতন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আবার অনেকে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
মেহেদী হাসান নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী সেখানে লিখেছেন, ‘আপনারা অপহরণকারী চক্রের নাম প্রকাশ করে গ্রেপ্তারে আলটিমেটাম না দিয়ে উল্টো সাধারণ মানুষকে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন! অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য চিরুনী অভিযানের ঘোষণা দিলেই তো হয়। নাকি এক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা ব্যর্থ?!’
এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশের কাজ অপরাধী ধরা। সেটি না করে যদি তারা মানুষকে সচেতন আর সতর্ক করার কাজে নেমে পড়েন তাহলে এটা তাদের অসহায়ত্ব হিসেবেই প্রকাশ পাবে।’
‘মানুষকে সচেতন করা অবশ্যই ভাল কাজ। তবে খেয়াল রাখতে হবে সচেতন করতে গিয়ে যেন মানুষকে আতঙ্কিত করে ফেলা না হয়। অপহরণের যে অভিযোগগুলো এসেছে তার সুরাহা না করে মানুষকে সচেতন হওয়ার কথা বলা হলে তো পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।’
এ পর্যন্ত অপহরণের কতগুলো ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে ওসি গোলাম দস্তগীর জানান, গত মাসে দুই ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। আর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে একটি।
জৈন্তাপুর থানা সুত্রে জানা গেছে গত ২০ মে চিকনাগুল উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়। পরদিন তার পরিবার থানায় অভিযোগ করে। এরপর ২৯ মে সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির আরেক ছাত্রী স্কুলে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়। তাদের এখনও পাওয়া যায়নি।
এর আগে গত ৭ মে সিলেট ক্যান্টমেন্ট বোর্ড স্কুলের এক ছাত্রী জৈন্তাপুর থেকে নিখোঁজ হয়। এরপর অপহরণের অভিযোগে থানায় সাধারন ডায়েরি করে ওই ছাত্রীর পরিবার। ২৪ মে তাকে টাঙ্গাইল থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণের অভিযোগে আটক করা হয় এক তরুণকে।
ওসি জানান, ওই ঘটনাটি অবশ্য অপহরণ নয় বলে পরে জানা গেছে। মেয়েটি স্বেচ্ছায় ওই তরুণের সঙ্গে চলে যায়।
তিনি আরও জানান, সবশেষ গত মঙ্গলবার সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রীকে দুই নারী অপহরণের চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই ছাত্রীর বাবা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল আমার মেয়ে। ছৈয়া এলাকার রাস্তায় দুজন অপরিচিত নারী তাকে একটি কাগজ পড়ে দেয়ার জন্য বলে। কাগজটি মেয়ে হাতে নেয়ার জন্য এগিয়ে গেলে তারা ওই কাগজ তার মুখে গুঁজে একটি ইজিবাইকে তুলে নেয়। পরে তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে আমার মেয়ে লাফ দিয়ে নেমে পালিয়ে আসে।’
ওসি গোলাম দস্তগীর জানান, এ খবর জানার পরই মূলত অপরণকারীদের ধরতে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। ওই ছাত্রীর পরিবার কোনো লিখিত অভিযোগ না দিলেও থানা পুলিশ তদন্ত করছে।