বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘সাগরে ভেসে চেন্নাই যাওয়া’ ফিরোজের তথ্যে বহু অসংগতি

  •    
  • ৭ জুন, ২০২২ ১৯:১৮

ভাইয়ের বরাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছিল, ফিরোজ কলাগাছ ধরে সাগরে ২৪ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন। তবে দেশে ফেরার পর এই তরুণ এখন বলছেন, ৪-৫ ঘণ্টা ভেসে থাকার পরেই তাকে উদ্ধার করেন ভারতীয় জেলেরা।

কুয়াকাটা সৈকত থেকে নিখোঁজ ব্যবসায়ী ফিরোজ শিকদার ১০ দিন পর নিজ এলাকায় ফিরেছেন। তাকে হেফাজতে নিয়েছে পটুয়াখালীর মহিপুর থানা পুলিশ।

ফিরোজ ও তার পরিবারের দাবি, কুয়াকাটায় সাগরে গোসলে নেমে তিনি ভেসে যান। সাগরে তিনি একটি কলাগাছ ধরে ভেসে ছিলেন। পরে ভারতীয় ট্রলারের জেলেরা তাকে উদ্ধার করেন। এরপর ভারতীয় কোস্টগার্ড তাকে চেন্নাই নিয়ে যায়।

তবে তার বক্তব্যে অনেক অসংগতি রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সাগরে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকা মানুষের শারীরিক যেসব জটিলতা তৈরি হওয়ার কথা সে ধরনের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।

ভাইয়ের বরাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছিল, ফিরোজ কলাগাছ ধরে সাগরে ২৪ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন। তবে দেশে ফেরার পর এই তরুণ এখন বলছেন, ৪-৫ ঘণ্টা ভেসে থাকার পরেই তাকে উদ্ধার করেন ভারতীয় জেলেরা।

মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফিরোজের কুয়াকাটা থেকে চেন্নাই যাওয়ার বিষয়টি অস্পষ্ট। তার কথাবার্তাও অসংলগ্ন। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে আমরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।’

থানায় মঙ্গলবার দুপুরে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের সামনে নিখোঁজ হওয়ার পরের ঘটনার এবং দেশে ফিরে আসার বর্ণনা দেন। তবে এই বর্ণনার সঙ্গে এর আগে তার ভাইয়ের দেয়া তথ্যের অনেক অসংগতি পাওয়া গেছে।

এর আগে সোমবার দুপুর ১২টায় বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফেরেন ফিরোজ। সেখানকার পোর্ট থানায় নেয়ার পর স্বজনেরা তাকে মাইক্রোবাসে করে সরাসরি মহিপুর থানায় নিয়ে আসেন।

যা বলছেন ফিরোজ

ফিরোজ শিকদারের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় আমখোলা বাজারে। তার দাবি অনুযায়ী, আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে কুয়াকাটায় বেড়াতে গিয়ে গত ২৭ মে দুপুরে গোসলের সময় সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে যান।

এই তরুণ বলছেন, ১৫-২০ মিনিট পর পানির ওপরে ভেসে উঠে একটি কলাগাছ দেখতে পেয়ে আঁকড়ে ধরেন। তারপর কলাগাছ ধরে সাগরে চার-পাঁচ ঘণ্টা ভেসে থাকার পর একটি মাছ ধরার ট্রলারের জেলেরা তাকে উদ্ধার করেন।

ওই ট্রলারে বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা টাঙানো ছিল দাবি করে ফিরোজ বলেন, ‘ট্রলারের জেলেরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছিলেন। রাতে তারা আমাকে খাবারও খেতে দেন। পরদিন শেষ বিকেলে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজে আমাকে তুলে দেন ট্রলারের জেলেরা।

‘এরপর পাঁচ-ছয় দিন জাহাজটি সাগরে চলার পর উপকূলে অফিসে নিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে কর্মকর্তারা বলেন এটি চেন্নাই। জাহাজের সবার পরনে সাদা পোশাক ছিল।’

ফিরোজ দাবি করেন, চেন্নাইয়ে নেয়ার পর তাকে একটি ভবনের নিচতলায় রাখা হয়। সেই ভবনের ওপরের দিকে কর্মকর্তারা থাকতেন। চেন্নাইয়ের খাবার খেতে না পারায় তিনি শুধু পানি খেয়ে থাকতেন।

তিনি বলেন, ‘একদিন একজন অফিসার কাগজে একটি স্বাক্ষর রেখে বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতে আমাকে দুই হাজার রুপি দেন। সেই টাকা থেকে এক হাজার পঞ্চাশ রুপি দিয়ে একটি মোবাইল সেট কিনি। পরে এক অফিসার একটি মোবাইল সিম দিলে সেটি মোবাইলে ভরে গত শনিবার দুপুরে আমার ভাই মাসুদ শিকদারকে ফোন দিয়ে সব ঘটনা জানাই।’

ফিরোজের দাবি, শনিবার বিকেলে নৌবাহিনীর অফিসাররা তাকে চেন্নাই বিমানবন্দরে নিয়ে যান। রাত ১০টার বিমানে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। মধ্যরাতে কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সেখানকার কর্মকর্তারা ফিরোজকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যান। এক দিন রাখার পর সোমবার সকালে তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তাকে ছয় হাজার রুপি দেন কলকাতা বিমানবন্দরের ক্যাম্পের কর্মকর্তারা।

ট্রেন থেকে নেমে ফিরোজ অটোরিকশায় চড়ে দুপুরে বেনাপোল চেকপোস্টে আসেন। এর আগে তার কাছ থেকে বিমান, ট্রেন ও মোবাইল ফোন কেনার সব কাগজপত্র রেখে দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তার ব্যবহৃত মোবাইল সিমটিও রেখে দেয়া হয়।

ফিরোজ জানান, বাংলাদেশের অংশে এলে পুলিশ আমার পাসপোর্টসহ কাগজপত্র দেখতে চায়। এ সময় স্বজনেরা নিখোঁজের বিষয়টি পুলিশকে জানান। মহিপুর থানায় করা জিডির কপিও দেখানো হয়। পরে ইমিগ্রেশন পুলিশ মহিপুর থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।

ভাইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে গড়মিল

ফিরোজ সাগরে কয়েক ঘণ্টা ভেসে থাকার তথ্য দিলেও এর আগে তার ভাই মাসুদ শিকদার নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, তার ভাই এক দিন এক রাত কলাগাছ ধরে সাগরে ভেসে ছিলেন। এরপর ভারতীয় জেলেরা তাকে উদ্ধার করে কোস্ট গার্ডের কাছে দেয়।

মহিপুর থানায় মঙ্গলবার ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক ঘণ্টা সাগরে ভেসে থাকার পরেও তিনি সুস্থ ছিলেন। এ কারণে তাকে উদ্ধারের পর ভারতে নিয়ে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। তবে ফিরোজের বরাত দিয়ে তার ভাই মাসুদ শিকদার বলেছিলেন, চেন্নাই কোস্টগার্ড ফিরোজকে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিয়েছে।

ফিরোজের দাবি অনুযায়ী, কুয়াকাটা গোসলে নেমে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ডুবে যাওয়ার দাবিও অস্বাভাবিক। তা ছাড়া সাগরের অভিজ্ঞ জেলেরা বলছেন, সাগরের লোনা পানিতে ভেসে থাকার উপযোগী কলাগাছ পাওয়ার ঘটনা বিস্ময়কর। আবার সাগরের প্রকৃতি অনুযায়ী ভাসমান বস্তু যেখানে তীরের দিকে আসার কথা, সেখানে কলাগাছ ধরে ভেসে থাকা কারও গভীর সাগরের দিকে যাওয়ার দাবি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

ভারত থেকে ফেরার সময়ে ফিরোজের মোবাইল ফোনের সিমসহ সব কাগজপত্র রেখে দেয়ার দাবি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে পুলিশ ও স্থানীয়দের। স্থানীয় সংবাদকর্মী আবুল হোসেন রাজু বলেন, ‘এগুলো সব শিখানো কথা। অবাস্তব কথা। চেন্নাই থেকে ফিরোজকে বিমানে কলকাতা পাঠানো আর কলকাতা থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ পাঠানো সবকিছুই সন্দেহজনক।‘

কুয়াকাটা প্রেস ক্লাবের সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো মানুষ ৪-৫ঘণ্টা সাগরে ভাসার পর কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। অথচ ফিরোজ বলছেন, ট্রলারে ওঠার পর তিনি সুস্থ ছিলেন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে পুরো ঘটনা সাজানো।’

ফিরোজের দাবি অনুযায়ী, গত শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি কলকাতা অবস্থান করেছিলেন। অথচ ওই রাতে ১২টা ২৫মিনিট পর্যন্ত মহিপুর থানার ওসি আবুল খায়ের ফিরোজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ওসি তখন নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন, ফিরোজ তখনও চেন্নাই আছেন।

গলাচিপা থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, ফিরোজ নিখোঁজ হওয়ার ঠিক এক দিন পর তাদের জমিজমা নিয়ে বিরোধের ফয়সালার জন্য একটি চূড়ান্ত সালিশ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। নিখোঁজের ঘটনার সঙ্গে এর যোগসূত্র উড়িয়ে দেয়া যায় না।

প্রশাসনের বক্তব্য

বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি বি এম কামাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ফিরোজ শিকদারকে পাঠানো হয় ইমিগ্রেশন থেকে। তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী আমরা ফিরোজ শিকদারকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।’

বেনাপোল ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. ইলিয়াস বলেন, ‘সে (ফিরোজ) কীভাবে ওপার থেকে এপারে আসছে তা ফিরোজের কাছ থেকেই জেনে নিন। ইমিগ্রেশনে তাকে আটকানোর পর আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সে বলেছে ওপারের একটা লোক তাকে দিয়ে গেছে। এখন কোন লোক কীভাবে তাকে দিয়ে গেছে সেটি ফিরোজই বলতে পারেন।’

বিষয়টি নিয়ে মহিপুর থানার ওসি আবুল খায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফিরোজ শিকদারকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কলাপাড়া সার্কেল) আবুল কালাম আজাদের অফিসে পাঠানো হবে। এ বিষয়ে স্যার যে ডিশিসন নেয়ার নেবেন।’

এ বিভাগের আরো খবর