বিল ও ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নীতিমালা পরিবর্তনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে সায় দেননি ব্যাংক ও সেবা সংস্থার প্রতিনিধিরা।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন-আরপিও অনুযায়ী, যেকোনো অঙ্কের বিল ও ঋণখেলাপিরাই ভোটে অযোগ্য। তবে যারা মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার এক দিন আগে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারেন, তারা ভোটে অংশ নিতে পারবেন। ক্ষুদ্রঋণ বা বিলের ক্ষেত্রে সাত দিন আগে পরিশোধ করতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে মনোনয়ন বাতিল বলে গণ্য হবে।
নির্বাচন কমিশন চাইছিল ‘ছোট’ ও ‘বড়’ ঋণ ও বিল খেলাপিদের আলাদা করতে। তাদের যুক্তি, অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট অঙ্কের কথা প্রার্থীদের জানা থাকে না। যেমন, কারও ক্রেডিট কার্ডের একটি বিল বাকি, কারও বিদ্যুতের একটি বা দুটি বিল বাকি। তারা হয়তো জানেও না এগুলো বাকি। তাই কমিশন চাইছিল, যাদের বিরুদ্ধে ঋণ ও বিল খেলাপির মামলা আছে, কেবল তারা ভোটে অযোগ্য হবেন।
কমিশনের যুক্তি হলো, যিনি ১২০ টাকা বিল বা ঋণ বাকি, আর যাদের কাছে ব্যাংক বা সেবা সংস্থা ১২ কোটি টাকা পায়, দুই পক্ষই আইনের দৃষ্টিতে খেলাপি। কিন্তু দুই পক্ষকে এক চোখে দেখা উচিত নয়।
বিষয়টি নিয়ে সোমবার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তিতাস, ডেসকোর মতো সেবা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এবং আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন।
তবে কমিশনের চিন্তাধারার সঙ্গে অন্যরা একমত হননি আলোচনায়। ব্যাংক ও সেবা সংস্থার যুক্তি হলো, খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে সব সময় মামলায় যাওয়া যায় না। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেবা সংস্থার তালিকায় নাম থাকলেই তাদের ভোটে অযোগ্যের নীতি বজায় রাখা উচিত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ঋণ ও বিল খেলাপিদের ভোটে আটকাতে শুধু মামলাকে প্রধান্য দিতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাতে সম্মতি দেয়নি ব্যাংক ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকাভুক্ত হলেই খেলাপি হিসেবে ভোটে অযোগ্য থাকবেন। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) বিধানই বহাল রাখতে হবে।
সিইসি বলেন, ‘আজকে অধিকাংশরাই বলেছেন, ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে এখন যে বিধান রয়েছে, তা থাকলেই ভালো হয়। আমরা যেটা প্রস্তাব করেছিলাম- এটাতে ওনারা খুব কমফোর্টেবল ফিল করেন না।
‘আরও একটু চিন্তা করে আরপিও সংশোধন করা হবে কি না, তা পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
ব্যাংকের ঋণ কীভাবে আদায় করতে হবে তা ব্যাংকের নিজস্ব বিষয় মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় তারা (খেলাপি) শক্তিশালী। ঋণ ও বিল খেলাপি হয়ে তারা পরিশোধ না করেও পারবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য জটিল হয়।’
খেলাপিদের কেন ছাড়ের চিন্তা
সিইসি বলেন, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার মৌলিক অধিকার। তাতে যেনতেনভাবে কারও অধিকার খর্ব না করার জন্য ভিন্ন চিন্তা করেছে ইসি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ-টেলিফোন বিল নিয়ে বাহুল্য মনে হয়েছিল কমিশনের। বিল না দিলে লাইন কেটে দেয়া যায়। আবার নানা কারণে হয়তো জানেও না বিল খেলাপির তথ্য। আমরা প্রস্তাব করেছিলাম- তাদের বিরুদ্ধে যদি মামলা হয়, তাহলে খেলাপি বলতে চাই।’
তবে ব্যাংকাররা কেবল মামলার ভিত্তিতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার চিন্তায় সায় দেননি বলে জানান সিইসি। বলেন, ‘ব্যাংকাররা বলছেন, যেকোনো খেলাপিই সিরিয়াস ডিফল্ডার।’
তিনি বলেন, ‘সভায় ব্যাংকাররা আগের বিধানটা কমফোর্টেবল বলছেন। সিআইবি থেকে যে তালিকা সরবরাহ করা হয়, তার ভিত্তিতে খেলাপি নির্ধারিত হয়ে থাকে। মামলা করার বিষয়টি যুক্ত করতে চাইলে তাদের আপত্তি নেই।
ব্যাংক ও সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা যা বলছেন
পূবালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক দেওয়ান রুহুল আহসান বলেন, ‘ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিআইবি রিপোর্টকে প্রাধান্য দিতে বলেছি আমরা। সেই সঙ্গে প্রচলিত আইন যদি সংশোধন করতে চায় তাহলে ওই অংশটি (মামলা) যুক্ত করতে পারে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মামলা করতে (খেলাপিদের বিরুদ্ধে) অসুবিধা নেই। মামলা তো করা হয়। তবে সিআইবিতে যাদের নাম থাকবে তাদের ঋণখেলাপি বলতে হবে। মামলা করতে অনেকগুলো ধাপ থাকে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
ডেসকোর চিফ ইঞ্জিনিয়ার রশিদুর রহমান জানান, বিল খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধানে তাদের সম্মতি নেই। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানই বহাল রাখার পক্ষে তারা মতামত দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে বিল পরিশোধ না করলেই বিল খেলাপি হয়ে যান সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি গ্রাহককে জানানো হয়। কিন্তু মামলা করতে গেলে সেবাপ্রতিষ্ঠানের নানা ঝুঁকিও রয়েছে।’
বৈঠকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়েরর অতিরিক্ত সচিব (ড্রাফটিং) হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ডিন সীমা জামান, ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজিজুল হক পান্না, আইন ও বিচার বিভাগের উপসচিব (প্রশাসন) শেখ গোলাম মাহবুব, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মাকসুদা বেগম, সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আব্দুল কদ্দুস, বিটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ফিন্যান্স অ্যান্ড বাজেট) মাজহারুল ইসলাম, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের স্পেশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট মীর ইকবাল হোসেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কান্ট্রি হেড নুর হোসাইন আল কাদেরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বাজেট) ফারুকুজ্জামান, তিতাস গ্যাসের পরিচালক (অর্থ) অর্পণা ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।