‘আপু আমার, কেমন আছো? ঈদে কিন্তু বাড়ি যাচ্ছি। তোর জন্য অনেক পোশাক কিনে দিয়ে যাব। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। একদম দুষ্টুমি করবি না।’
ছোট বোন রিমঝিম খাতুনের সঙ্গে এগুলোই ছিল ফায়ার ফাইটার রবিউল ইসলাম রবির শেষ কথা। শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে কনটেইনার ডিপোতে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তিনি একজন।
২৭ বছর বয়সী রবির বাড়ি নওগাঁ শহরের চকপাথুরিয়া মহল্লার পূর্বপাড়ায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় রবি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দেড় বছর আগে যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে।
টেলিভিশনের সংবাদ দেখে রোববার রবির নিখোঁজের খবর পায় পরিবার। তারপর থেকেই তারা ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কোথাও কোনো খোঁজ মিলছে না রবির। ভেঙে পড়েছে পরিবারের সবাই।
৯ বছর বয়সী রিমঝিম জানায়, তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় শনিবার সকাল ৯টার দিকে। ভাই নিখোঁজের খবর পেয়ে কিছুতেই তার কান্না থামছে না।
কাঁদছে আর মাকে বলছে, ‘আম্মু, ভাইয়া ফোন রিসিভ করে না কেন? আমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব। টিভিতে দেখাচ্ছে অনেক মানুষ মারা গেছে। আম্মু, আমার ভাইয়া তো সুস্থ আছে তাই না? আল্লাহ যেন ভাইয়াকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়।’
বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাত ৯টার দিকে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস খবর পায় ৯টা ২৫ মিনিটে। রাত ১১টার দিকে শুরু হয় বিস্ফোরণ। কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বিস্ফোরণে আগুন দ্রুত আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের শব্দে ভেঙে যায় আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাঁচ।
একে একে বের করা হয় হতাহতদের। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ এ। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আছেন নয়জন। নিখোঁজের তালিকায় থাকা ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মীর মধ্যে রবি একজন।
নিখোঁজ ফায়ার ফাইটার রবিউল ইসলাম রবি
রবির মা ফাইমা বেগম নিউজবাংলাকে জানান, শনিবার রাতে এশার নামাজের পর ছেলের সঙ্গে সামান্য কথা হয়। ছেলে ব্যস্ত থাকায় পরে ফোন দিতে বলে। আমি আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ছেলেকে ফোন দিতে পারিনি।
রোববার ভোর ৫টার দিকে ছেলেকে কল দিলে অফিসে যিনি ডিউটিতে ছিলেন তিনি রিসিভ করে বলেন, ‘রবিউল ডিউটিতে গেছে। তার জন্য দোয়া করেন।’
ফাইমা বলেন, ‘সকাল ৮টার দিকে টেলিভিশন চালু করে দেখি আগুনের সংবাদ। সামনের ঈদে ছেলে বাড়ি আসত। জানি না আমার ছেলের এখন কী অবস্থা।’
রবির চাচাতো বোনের স্বামী এরশাদ আলী বলেন, ‘রবির অনেক পরিকল্পনা ছিল। ছোট দুই ভাইবোনকে পড়াশোনা করাবে। নিজেও বাড়ি করে বিয়ে করবে। তার কোনো খোঁজ মিলছে না। আমরা চাই রবি ফিরে আসুক আমাদের মাঝে।
‘যদি কোনো ধরনের অঘটন ঘটেই থাকে তাহলে সরকারের কাছে দাবি, পরিবারটিকে যেন যথাযথভাবে সহযোগিতা করা হয়।’
বড় ছেলের খোঁজে ছোট ছেলে রনিকে নিয়ে রোববার সকাল ৯টার দিকে রওনা দেন বাবা খাদেমুল ইসলাম। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পৌঁছান রাত সাড়ে ১০টার দিকে।
তিনি মোবাইলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের অনেক সহকর্মী মারা গেছেন। আবার অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনন্সিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকায় গিয়ে নিজে দেখে শনাক্ত করতে বলেছেন।’
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ইনচার্জ নূরে আলম দুলাল বলেন, ‘হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় আমাদের অনেক কর্মীই মারা গেছেন। আবার অনেকেই মারাত্মক আহত হয়েছেন। হতাহতদের চেহারা ঠিকভাবে চেনার উপায় নেই।
‘অনেক কর্মীকেই ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রবিউলও রয়েছে আশা করছি। তবে অবস্থা খুবই গুরুতর। তার বাবাকে ঢাকায় যেতে বলেছি যেন নিজেই ছেলেকে শনাক্ত করতে পারেন।’