গোপন কক্ষে কর্মী রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে বাটন চেপে নিজের পক্ষে ভোট নেয়ার পরিকল্পনা করা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশের পাশাপাশি ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরীর বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
রোববার এ সংক্রান্ত এক নির্দেশনা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছেন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব আতিয়ার রহমান।
কমিশনের যুগ্মসচিব জনসংযোগ পরিচালক আসদুজ্জামান আরজু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। নির্দেশনায় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সেই ইউনিয়নে ভোট স্থগিত করার কথাও বলা হয়।
আগামী ১৫ জুন এই ইউনিয়নে ভোট হওয়ার কথা ছিল। সম্প্রতি নৌকার প্রার্থী মুজিবুলের দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এর মধ্যে প্রথম ভিডিওতে দেখা যায়, মুজিবুল ঘোষণা দেন, ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের বাটন টিপতে নিজের লোক রাখবেন। ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন এমন কথাও বলেন তিনি।
গণমাধ্যমে বিষয়টি আসার পর স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে নির্বাচন কমিশন। এতে ভিডিওর সত্যতার প্রমাণ পায় তারা।
মুজিবুলের ভাইরাল হওয়া আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি বলছেন, তিনি মনে করেন ইভিএমে অন্যের ভোট দিয়ে দিয়ে দেয়াই সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচন তার ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে বলেও দাবি করেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়া নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার বেশ কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে হামলার দায়ে ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার মেয়র প্রার্থী আব্দুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকেও সতর্ক করে সংস্থাটি।
নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গ করার অভিযোগ ওঠায় শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হাসান, ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকী এবং ঝিনাইদহ-১ আব্দুল হাইয়কে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে কমিশন।
আগের নির্বাচন কমিশনগুলো যখন অভিযোগ না পেলে কিছু করার নেই বলে বিবৃতি, ব্যাখ্যা দিতেন, সেখানে বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজ উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কমিশন প্রথমবারের মতো একটি কমিটিও গঠন করেছে, যারা প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বেলা ১১ টার মধ্যে রিপোর্ট করেন।
আগামী ১৫ জুন হতে যাওয়া কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ভোটে প্রথমবারের মতো সব কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। ভোটে সরকারি চাকরিজীবীরা কারও পক্ষ নিলে তার কারাদণ্ড হবে বলে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে।
মুজিবুলের দুই ভিডিওতে যা ছিল
গত সপ্তাহের সোমবার প্রথমে যে ভিডিওটি ছড়ায়, তাতে দেখা যায়, নৌকার প্রার্থী মুজিবুল এক সমাবেশে নিজের কর্মীদের বলেন, ব্যালটে ভোট হলে তিনি সহজেই সব ভোট দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু ইভিএমে ভোট হবে, তাই তার অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘তো এখানে ইভিএম একটা করেছে সরকার। তো কী করতাম। একটু কষ্ট করে গিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে ভোট দিতে হবে, চাপ দিতে না পারলে চাপ দেয়ার জন্য সেখানে আমি মানুষ রাখব। তো আমাকে একটু দোয়া করবেন সকলে।
‘রিকশা করে পারেন, যেভাবে পারেন ভোটটা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, ইভিএমের ভোট। ইভিএম না হলে আমি কাউকে খুঁজতাম না, ভোট আমি মেরে দিতাম। যেভাবে পারি ভোটটা মেরে দিতাম।
‘ইভিএমে আইডি কার্ড ঢুকিয়ে দিতে হয়, নইলে হয় না। এটা না হলে আমি রাতেই নিয়ে ফেলতাম। তো আপনারা একটু কষ্ট করেন, আপনাদের একটু কষ্ট করে ওটা নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। কথা বোঝেননি?’
এই ভিডিও নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে শুক্রবার ছড়ায় ৫৪ সেকেন্ডের আরেক ভিডিও। এতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ভোট সুষ্ঠু করি যে আমরা, অসুষ্ঠু করি যেও আমরা। আমরা বললে সুষ্ঠু, না বললে অসুষ্ঠু। যেদিকে দেখি, সেদিকেই।’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে হওয়া বাঁশখালী পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “পৌরসভার ভোটের সময় আমাকে এক বিএনপি নেতা ফোন দিয়েছিল। বলে যে, ‘আমাকে মারতেছে, এভাবে গালি দিচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘কেন কথা বলতেছ, কথা বলিও না।’ সে বলে যে, ‘কেউ কেউ বলতেছে কামরুল (স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী) মেয়র হবে, সুষ্ঠু ভোট হবে।’ আমি বললাম, ‘সুষ্ঠু ভোট হবে সরকার লিখিত দিয়েছে নাকি?’ সে বলতেছে, ‘কেন, ইভিএমে ভোট হবে।’ আমি বলছি, ‘ইভিএমে নিতে (ভোট) পারে না?’ সে বলে যে, ‘না।’ আমি বললাম, ‘তোমার ভোট আমি নিজে মারব। এটা হলো সুষ্ঠু ভোট। আমাদের এগুলো জীবনেও জিজ্ঞেস করতে হবে না’।”
মসজিদের মুসল্লিদের মতো সবাইকে ভোট দিতে হয় না উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন দলের এ চেয়ারম্যান প্রার্থী বলেন, ‘মুসলমানি কাজ হচ্ছে একজনে নামাজ পড়বে, এর পেছনে আরও পাঁচ হাজার মানুষ নামাজ পড়বে। এত মানুষের ভোট দেয়ার দরকারও নাই।’
এ ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিডিওটি পুরোনো, ২৮ তারিখের। এটা অলরেডি পত্র-পত্রিকায় আসছে। আর এ রকম কথাগুলো আমি বলিও নাই।’
ইভিএমের চ্যালেঞ্জ মুজিবুলদের থামানো
ব্যালটের ভোটের ক্ষেত্রে একজনের কাগজ অন্যের জোর করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অতীতে বহুবার ঘটেছে। তবে ইভিএমে একজন ভোটারের আঙুলের ছাপে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে হয় বলে একজনের ভোট অন্যের দেয়া সম্ভব নয়।
তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গোপন কক্ষে থাকা ইভিএম মেশিনে বোতাম টিপে ভোট দিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে। এমনও দেখা গেছে, গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দেয়ার নাম করে কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। এটি প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা করে থাকেন।
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই; আর কোনো চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। একটা ডাকাত, সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান। দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’