চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সাত কর্মীসহ কমপক্ষে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানাধীন (জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় লাগা আগুনে দগ্ধ ও আহত হয়েছে দুই শতাধিক মানুষ। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেড একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে ২০১১ সালের মে মাসে। ১১ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি ও আমদানি কনটেইনারাইজড কার্গো থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রপ্তানি ও আমদানিকৃত পণ্যের কনটেইনার ও খালি কনটেইনার রাখা হয় ডিপোটিতে।
সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন রোববার ৮টায় জ্বলতে থাকে। ছবি: নিউজবাংলা
অগ্নিকাণ্ডে ডিপোটিতে তিন দফা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়েছে। কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণেই এমন বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
আগুনের খবর পেয়ে একে একে ছুটে আসে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। নোয়াখালী এবং লক্ষ্মীপুর জেলা থেকেও পরে যোগ দেয় কয়েকটি ইউনিট। রোববার সকাল পর্যন্ত আগুন নেভাতে আসা ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫টিতে।
কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা। আগুনের তীব্রতা ও ভয়াবহতার কারণে ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কাছেই যেতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এরই মধ্যে ফুরিয়ে যায় রিজার্ভার গাড়ির পানি।
হাইড্রোজেন পার অক্সাইডই ছিল অনেক কনটেইনারে, যা অ্যাভিয়েশন শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। উচ্চ চাপে এই রাসায়নিক বোতলজাত করা হয়ে থাকে। এমনটি জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান।
তবে ডিপোটিতে পানির কোনো উৎস না থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।
ডিপোটিতে এই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ খালাস ও মজুতে পর্যাপ্তসংখ্যক অগ্নিনির্বাপকসহ সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল কি না সেই প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন মহল। আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগে থেকে জানানো হয়নি ডিপোটিতে কনটেইনার ভর্তি ভয়াবহ রাসায়নিক পদার্থের বিষয়ে। এতে প্রশ্ন ওঠে কোম্পানিটির মালিকপক্ষের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে।
এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ডিপোর কর্মকর্তাদের বরাতে আমরা জানতে পেরেছি, কনটেইনারগুলোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল। তবে প্রথমে আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কেউ অবহিত করেননি। এমন রাসায়নিকের আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে। আমরা এই পদ্ধতিতে এবং ফোমের মাধ্যমে এখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করছি।’
বিএম কনটেইনার ডিপো প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ডাচ নাগরিক বার্ট প্রঙ্ক কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তাদের যৌথ মালিকানাধীন আবাসন প্রতিষ্ঠান সিটি হোম প্রপার্টির চেয়ারম্যানও বার্ট প্রঙ্ক। আর তাতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। মোস্তাফিজুর রহমানের বড় ও ছোট ভাই শফিকুর রহমান ও মুজিবুর রহমান এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদে রয়েছেন।
নেদারল্যান্ডসের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বার্ট প্রঙ্ক বাংলাদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে যৌথভাবে বিনিয়োগ করেছেন। চিটাগাং ডেনিম মিল লিমিটেড ও বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেড সেগুলোর অন্যতম। মোস্তাফিজুর রহমান ও তার ভাইদের সঙ্গে প্রঙ্কের পারিবারিকভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে।
সিটি হোম লিমিটেডের ওয়েবসাইটে মোস্তাফিজুর রহমানের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের একজন বহুমুখী এবং উদীয়মান উদ্যোক্তা। তিনি বৈশ্বিক বাণিজ্যের সূক্ষ্মতা এবং চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্প পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি এই গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনে হতাহতদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মালিকপক্ষ। হতাহতদের পাশে থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কনটেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারণা করছি।
‘নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হতাহতদের পাশে থাকব। আহতরা যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় আমরা বহন করব। এ দুর্ঘটনায় যারাই হতাহত হয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। পাশাপাশি সব হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেয়া হবে।’
বিএম কনটেইনার ডিপো ও সিটি হোম লিমিটেডের পরিচালক মুজিবুর রহমান হলেন মোস্তাফিজুর রহমানের ছোট ভাই। পারিবারিক ব্যবসাকে আরও সমৃদ্ধ করতে এবং বিনিয়োগে নতুন সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি শিল্পের প্রতিটি সেক্টরে তাদের ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি আরও উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তিনি, উল্লেখ করা হয়েছে ওয়েবসাইটে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাজারে তাদের ব্যবসা বিস্তারে তার দক্ষতা রয়েছে।
পরিবারে ভাইদের মধ্যে শফিকুর রহমান সবার বড়। ব্যবসা ও বিনিয়োগে তার দূরদৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা তাদের পারিবারিক ব্যবসার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে- এমনটি বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে।