কুয়াকাটা সৈকতে গোসলে নেমে নিখোঁজ ব্যবসায়ী ফিরোজ শিকদারের সন্ধানের খবরটি রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
শনিবার দুপুরে বড় ভাই মাসুদ শিকদারের মোবাইল ফোনে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফিরোজ ফোন করলে মুহূর্তেই খবরটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ফোনে ফিরোজ দাবি করেন, তিনি ভারতের চেন্নাইয়ে আছেন এবং ২৭ মে দুপুরে কুয়াকাটা সৈকতে গোসল করার সময় ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন। পরে একটি কলাগাছ ধরে ভাসতে ভাসতে ভারতের জলসীমায় পৌঁছালে দেশটির জেলেরা তাকে উদ্ধার করে সেখানকার কোস্ট গার্ডের হাতে তুলে দেন।
ফিরোজের ভাই মাসুদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে এমন খবর প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তবে বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন সমুদ্রের অভিজ্ঞ মৎস্যজীবীরা। তাদের মতে, কুয়াকাটা থেকে ভারতীয় জলসীমার দূরত্ব তিন থেকে চার শ কিলোমিটার পশ্চিমে। এত দূরের সমুদ্রপথ কলাগাছে পাড়ি দেয়া বা ভেসে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
ফিরোজের ভাই মাসুদের রহস্যে ঘেরা বক্তব্য
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় আমখোলা বাজারে শনিবার রাতে ফিরোজ শিকদারের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসে তার ভাই মাসুদ শিকদারের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
মাসুদ বলেন, ‘গত ২৭ মে কুয়াকাটা ও আশপাশের এলাকায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ভাইকে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। পরে স্থানীয়দের পরামর্শে বিভিন্ন ফকির-কবিরাজ ও গণকদের কাছে যাই। যার কাছেই গেছি সেই-ই বলেছে, ভাই জীবিত আছে। গতকাল এক গণক বরগুনার পাথরঘাটা এলাকায় খুঁজতে বলেন।
‘সেই অনুযায়ী আজ (শনিবার) সকালে পাথরঘাটার খেয়াঘাট এলাকায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে ফরিদপুরের ভাঙ্গার দিকে রওনা হই। সেখানে একজন ফকির আছে- সে নাকি সবকিছু বলতে পারে। পাথরঘাটা থেকে দুপুর দেড়টার দিকে ভাঙ্গার কাছাকাছি যাই।
‘আনুমানিক দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে আননোন নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। রিসিভ করতেই শুনি আমার ভাই ফিরোজ কান্নাকাটি করছে। ওর কান্নার শব্দ শুনেই আমি শিওর হই। তখন তাকে জিজ্ঞেস করি- এটা তো বাইরের নম্বর, তুই পাইলি কই? তখন ফিরোজ বলে- ভাইয়া আমি এখন ইন্ডিয়া আছি। চেন্নাই।
‘ওই দিন (২৭ মে) গোসল করার সময় ঢেউয়ে আমারে সাগরের মধ্যে লইয়া গেছে। অনেক দূরে যাওয়ার পর একটা কলাগাছ পাই। হেইডা ধইরা মুই ভাসতে থাহি। মনে হয়, এক দিন এক রাইত ভাসার পর আমারে ইন্ডিয়ান জেলেরা উদ্ধার করে কোস্ট গার্ডের কাছে দেয়। তার পর মুই সুস্থ অইয়া আপ্নেরে ফোন দিছি।’
সাগরে কলাগাছ নিয়ে এত দূর ভেসে থাকা সম্ভব কি-না, জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘সম্ভব। তা ছাড়া ফিরোজ যেভাবে বলছে, আমি তাই বলছি।’
ফিরোজের কাপড়ের দোকান
ফিরোজ জানান, দুপুর দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে প্রথমে ফোন করার পর সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আরও ২-৩ বার তাকে ফোন দেন ফিরোজ। একাধিক নম্বর থেকে তাকে ফোন দেয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে একবার সেই নম্বরগুলোর একটিতে তিনি নিজে ফোন দিলে ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দেয়নি।
মাসুদ বলেন, ‘ফিরোজের সাথে প্রথমে কথা বলার পর আমার স্ত্রীকে জানাই। এ ছাড়া আর কাউকে জানাইনি। তবে বিকেলের দিকে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ, মহিপুর থানার ওসি আমাকে ফোন দেন। তখন আমি তাদেরও এই কথাগুলো বলেছি।
সবশেষ ফিরোজের সঙ্গে কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘সে বলছে, তাকে চেন্নাই এয়ারপোর্টে নেয়া হচ্ছে। কোস্ট গার্ডের সদস্যরা তাকে কলকাতা পাঠাবে এবং আমাকে কলকাতা থেকে ফিরোজকে আনার ব্যবস্থা করতে বলেছে।’
যে নম্বর থেকে ফিরোজ ফোন দিয়েছেন সেই নম্বর চাইলে রেগে যান মাসুদ। তিনি বলেন, ‘নম্বর দেয়া যাবে না। প্রশাসন চাইলে তাদের কাছে দেব। আপনাকে দেয়া যাবে না।’
সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি কীভাবে ছড়াল- সে বিষয়েও কিছু জানেন না বলে দাবি করেন মাসুদ।
মৎস্যজীবীদের মন্তব্য
প্রায় ৪০ বছর সাগরে মাছ ধরা আর মৎস্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কুয়াকাটার আলীপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক বড় রহস্য আছে এই ঘটনার সঙ্গে। প্রশাসনকে বলব, একটু অনুসন্ধান করলেই সব বেরিয়ে আসবে।’
আনসার মোল্লা জানান, কুয়াকাটা থেকে ভারতীয় জলসীমা প্রায় তিন থেকে চার শ কিলোমিটার পশ্চিমে। এত দীর্ঘ পথ কলাগাছ দিয়ে পাড়ি দেয়া কল্পনাকেও হার মানায়। তা ছাড়া গভীর সমুদ্রে লবণাক্ত পানি থাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কলাগাছ পচে গলে যায়।
তিনি বলেন, ‘কোনো জেলে সাগরে কলাগাছ দেখেছে বলে আমার জীবনে শুনিনি। আজকেই ফেসবুকে দেখলাম, আর সাংবাদিকরা তাই লিখল।’
আনসার মোল্লা দাবি করেন, সাগরে জোয়ার-ভাটা সব সময় একদিকে হয় না। ফিরোজ যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিন ছিল দক্ষিণা বাতাস। ওই বাতাসে কোনো লোক পশ্চিমে ভেসে যেতে পারে না। সমুদ্রে যদি কেউ ভেসেও গিয়ে থাকেন, তবে মরদেহ বা জীবিত অবস্থায় ভাসতে ভাসতে তার আবারও তীরে ফিরে আসার কথা।
সমুদ্রে মাছ ধরার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে মজিবুর রহমান বলেন, ‘গভীর সাগরে মাছ ধরার সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে পড়লে বাতাসে আমাদের কিনারে নিয়ে আসে। ট্রলার ডুবে গেলেও আমরা ট্রলারের জিনিসপত্র ধরে সাগরে ভাসতে থাকি। পরে অন্য ট্রলার গিয়ে উদ্ধার করে। আর ভারতীয় এলাকায় যাওয়ার এখন তো কোনো সুযোগই নাই।’
৫০ বছরের অভিজ্ঞ জেলে হালিম মুন্সি দাবি করেন, সমুদ্রের নোনা পানি যাদের শরীরে আটকে থাকে শুধু তারাই কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত নোনাপানিতে ভাসতে পারে।
এ ছাড়া শহরের মানুষের এত দীর্ঘ সময় সাগরে ভাসতে পারা ‘অস্বাভাবিক’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফিরোজের ভাই মাসুদ সিকদার
কী ঘটেছিল নিখোঁজের দিন
সেদিন গলাচিপার আমখোলা বাজারের ৭ বন্ধু কুয়াকাটায় ঘুরতে যান। দুপুরে তাদের মধ্যে ইয়ামিন নামের একজন ছাড়া সবাই সমুদ্রে গোসল করতে নামেন।
ইয়ামিন জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সবাই গোসল করতে নামেন। প্রায় ২০ মিনিট পর তারা ভেজা অবস্থায় ছবি তোলেন। ঘণ্টাখানেক পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবাই জড়ো হলেও ফিরোজকে পাওয়া যায়নি।
ফিরোজের সঙ্গে গোসলের সময় কেউ ছিল কি না- এমন প্রশ্নে ইয়ামিন বলেন, ‘ছবি তোলার পর আমি ওপরে এসে চা খেয়েছি। তা ছাড়া ৫০ অথবা ৬০ গজের মধ্যেই ওরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। যে যার মতো করে গোসল করার সময় সাঁতার কেটেছে। পরে সবাই ওপরে উঠে এলে আমরা ফিরোজকে না দেখে খুঁজতে থাকি।’
প্রশাসনের বক্তব্য
গলাচিপা থানার ওসি শওকত আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিকেল ৪টার দিকে মহিপুর থানার ওসি আমাকে ফোন করে জানান, চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে ফিরোজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওদের পরিবার বিষয়টি জানে।’
মহিপুর থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, একটি নিউজপোর্টালে খবর দেখে তিনি মাসুদকে ফোন দেন। তখন মাসুদই তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ওসি বলেন, ‘আমার থানায় যেহেতু জিডি হয়েছে, তাই আমি মাসুদের কাছ থেকে কনফার্ম হই।’
ওসি বলেন, ‘মানবিক কারণে অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছি। বিষয়গুলো আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মে দুপুরে কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়ে হোটেল রয়েল-এ অবস্থান নেন ৭ বন্ধু। পরে সৈকতে গোসল করতে নেমে ফিরোজ নিখোঁজ হলে পরের দিন তার ভাই মাসুদ মহিপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
ফিরোজ আমখোলা এলাকার মৃত মিলন শিকদারের ছেলে। তিনি আমখোলা বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করেন।