চা যেন স্বর্গীয় সোমরস– এমনটি মনে হয়েছিল নজরুলের। চায়ের সঙ্গে প্রেয়সীরও সঙ্গ চাওয়া কবির সুমন গেয়েছেন, ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।’
পানির পরই চা হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। গ্রামের টং দোকান থেকে পাঁচতারকা হোটেল, ভাঙা কুটির থেকে আলিশান বাড়ি– সবখানেই চায়ের সরব ও সগর্ব উপস্থিতি। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধূমায়িত চায়ে চুমুক দেয়া ছাড়া এখন তো দিন শুরুর কথা ভাবাই যায় না।
আজ জনপ্রিয়তম এই পানীয়টির দিন। আজ শনিবার জাতীয় চা দিবস। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে এই দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘চা দিবসের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা শিল্প।’ চা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরেকটি দিবসও উদযাপন করা হয়– সেটি ২১ মে ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’।
১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দিনটিকে স্মরণ করে গত বছর থেকে ৪ জুন জাতীয় চা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
চীন থেকে ভারতে চা
‘রসিককৃষ্ণ বললেন, দিস ইজ টি। রাধনাথ, তুমি চায়ের কথা শোন নাই? আগে চিন দেশ থেকে এ বস্তু আসতো। এখন আমাদের আসামেই যথেষ্ট হচ্চে।
‘...রামগোপাল দ্বিতীয় একটি বাটিতে প্যারিচাঁদের জন্য চা ঢালতে ঢালতে বললেন, নেশা হয় বৈকি। এর এক চুমুকেই পঞ্চন্দ্রিয়ে একটা এলার্টনেস এসে যায়। লাইক কিসিং এ ড্যামজেল... এন্ড ইউ ওয়ান্ট টু কিসিং এগেইন... এই নাও প্যারি, আজ আমি তোমায় নতুন সুধারসে দীক্ষা দিলাম।
...প্যারিচাঁদ বললেন, আমি বলি কি, এবার থেকে আমরা এই বস্তুই পান করবো। শুধু শুধু সুরা পান করে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করা কেন? সর্বনাশী সুরা যে দেশটারে ছারখার করে দিচ্চে।’
এই গল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসের।
তখন চীন থেকে ভারতের আসামে চা চাষ শুরু হচ্ছে। ব্রিটিশদের অনুকরণে বাঙালি অভিজাত সমাজ এই পানীয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছে। নাক সিঁটকানোও আছে অনেকের। আছে বিস্ময়ও। তবু বিস্তার লাভ করছে চা। এই কাহিনি সেই সময়ের। এই গল্পের রাধানাথ মানে রাধানাথ শিকদার, যিনি মাপজোক করে প্রথম জানিয়েছিলেন মাউন্ট এভারেস্টই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
ঐতিহাসিক মতে, সপ্তদশ শতকে চীন থেকে ভারতবর্ষে চা নিয়ে আসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই কোম্পানিটি স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে নিয়োগ করে চা গাছ সংগ্রহ ও ভারতবর্ষে তা নিয়ে আসার জন্য। নিয়োগ পাওয়ার পর গোপনে চীনে যান রবার্ট ফরচুন। সেখান থেকে তিনি ২০ হাজার চা গাছ দার্জিলিংয়ে পাচার করেন। সেই থেকে ভারতবর্ষে শুরু হয় চায়ের চাষ।
১৮২৬ সালে আসাম পূর্ণ ব্রিটিশ অধিকারে আসে। এরপর রবার্ট ব্রুসের ভাই চার্লস ব্রুস আসামে চা বাগান গড়ে তোলেন। আর ভারতীয়দের মাঝে প্রথম চা বাগান গড়ে তোলেন মণিরাম দেওয়ান, ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে যাকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশরা।
দেশে চায়ের উৎপাদন ও বৈচিত্র্য
চা বোর্ডের হিসাবমতে, গত বছর দেশে ৯৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে রেকর্ড ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়। দেশে এখন বৃহৎ চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭। আর ক্ষুদ্র চা বাগানের সংখ্যা আট হাজারের বেশি।
জাতীয় চা দিবস উদযাপন উপলক্ষে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘চায়ের নতুন ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতদিন শুধু দেশের পাহাড়ি অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও সিলেটে চা উৎপাদিত হতো। এখন দেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতেও চা হচ্ছে। এতে অন্য ফসল চাষে অনুপযোগী জমিগুলোয় চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে ও দেশে চা শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বিপুল পরিমাণ চা রপ্তানি করতে পারব।’
১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র (বিটিআরআই)। এখন পর্যন্ত উচ্চফলনশীল ও গুণগত মানসম্পন্ন ২১টি ক্লোন ও পাঁচটি বীজজাত চা উদ্ভাবন করেছে বিটিআরআই।
বিটিআরআইয়ের তথ্যমতে, আর্টিজেন চায়ের মধ্যে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্ল্যাক টি, অর্থোডক্স টি, বিশেষায়িত গ্রিন টি, হোয়াইট টি, ইয়েলো টি, হোয়াইট পিওনি টি, ওলং টি। এ ছাড়া ফ্লেভারযুক্ত চায়ের মধ্যে রয়েছে সাতকড়া টি, লেমন টি, আদা টি, মাসলা টি (জিরা, দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ), আর্ল গ্রে টি (তুরস্কের সাইপ্রাস ফল), জেসমিন টি, রোজ টি, তুলসী টি, পুদিনা/মিন্ট টি, স্টিভিয়া টি, সজনে টি, পাইনঅ্যাপল টি ও আমলকী টি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. মাঈনউদ্দিন জানান, ‘আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ২১টি চা গাছের ভ্যারাইটি বের করা হয়েছে, যেগুলো বিটি-১ (বাংলাদেশ টি), বিটি-২ এমন বিভিন্ন নামে আছে।’
সিলেট ও চা
বাংলাদেশে চায়ের প্রসঙ্গ এলেই সিলেটের কথা উঠে আসে। দেশের বেশির ভাগ চা বাগানই এই অঞ্চলে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষও শুরু হয় সিলেটে।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের অদূরে বর্তমান বিমানবন্দর সড়কের পাশের টিলাভূমিতে গড়ে ওঠে মালনীছড়া চা বাগান। মালনীছড়ায় ১ হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর লর্ড হার্ডসন চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘আসাম ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারস, সিলেট’-এ বলা হয়, সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।
এই বাগানের মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে চা শিল্পের যাত্রা শুরু। বাগানটি এখনও রয়েছে। ব্রিটিশ মালিকানা বদলে এখন বাঙালি মালিকানাতেই পরিচালিত হচ্ছে মালনীছড়া চা বাগান। বহু ইংরেজ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি ব্যবস্থাপকের হাত ঘুরে ১৯৮৮ সাল থেকে এটি ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। মালনীছড়া এখনও দেশের বৃহত্তম চা বাগান।
মালনীছড়ার সাফল্যের পর ১৮৬০ সালে হবিগঞ্জের লালচাঁন্দ চা বাগান ও মৌলভীবাজারের মির্তিঙ্গা চা বাগানে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। সিলেট বিভাগের এই তিন জেলাতেই রয়েছে চা বাগান। এ বিভাগে কেবল হাওরপ্রধান সুনামগঞ্জেই কোনো চা বাগান নেই।
বর্তমানে দেশে উৎপাদনে আছে ১৬৭টি চা বাগান, যার মধ্যে ১৩৫টি চা বাগানই সিলেট বিভাগে। বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। এই জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে বলা হয় ‘চায়ের রাজধানী’। এ ছাড়া চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২১টি। এখন উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল এলাকাতেও গড়ে তোলা হয়েছে চা বাগান।