পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক থেকে শরীয়তপুর শহর পর্যন্ত যেদিক দিয়ে চার লেনের সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাতে শত শত সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙতে হবে।
এই পথে কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় আছে ২৬টি আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ও আবাসিক স্থাপনা আছে দুই শতাধিক।
সব মিলিয়ে শরীয়তপুর শহরটি তছনছ হয়ে যাবে বলে জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে শহরবাসী কেউই এই প্রকল্পটি পছন্দ করছেন না। তারা শহর বাইপাস করে এই চার লেন নির্মাণের পক্ষে।
আবার শহরের ভেতরের দামি জমি অধিগ্রহণ করতে হলে এবং স্থাপনা ভাঙার ক্ষতিপূরণ দিতে হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজে অচলাবস্থার আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে চার লেনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলেও দুই লেনের সড়ক নির্মাণ করবে সড়ক বিভাগ। এরই মধ্যে ১২৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা শহরের ফায়ার সার্ভিস থেকে জাজিরা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার অংশের নির্মাণকাজ শুরু করেছে শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
এই সড়কের প্রেমতলা থেকে চাঁদপুর-শরীয়তপুর সড়কের মনোহরবাজার মোড় পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়ক জেলা শহরের ওপর দিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রেমতলা থেকে ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত ২ কিলোমিটার ইতোমধ্যে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে।
বাকি ছয় কিলোমিটার সড়ক শরীয়তপুর শহরের ওপর দিয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সড়ক বিভাগ। এই ৮ কিলোমিটার সড়কের পাশে তিন থেকে ছয় মিটারের মধ্যে রয়েছে সরকারি বেসরকারি ভবন।
জেলা শহরের ফায়ার সার্ভিস থেকে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চার লেন প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটি একনেক।
এই সড়ক নির্মাণের জন্য ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় সড়ক বিভাগ। গত বছরের জুলাই মাস থেকে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন।
এরই মধ্যে ২২টি এলএ কেসের মধ্যে ৭টির যৌথ তদন্ত শেষ করেছে জেলা প্রশাসন। বাকি ১৫টি কেসের ৪ ধারা নোটিশ দেয়া হয়েছে।
কী কী ভবন ভাঙতে হবে
যে আট কিলোমিটার এলাকা দিয়ে সড়ক নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার দুই পাশে আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিক শিল্পনগরী, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ভিডিপির কার্যালয়, পালং মডেল থানা, সিভিল সার্জন কার্যালয়, ২৫০ শয্যার শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল, শরীয়তপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স।
এমনকি উচ্ছেদ করতে হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ও। জেলা মডেল মসজিদ, সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজ, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্টেডিয়াম, পুলিশ লাইন্স, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বাস ভবনও সরাতে হবে।
এগুলো ছাড়াও বেসরকারি স্থাপনা ভাঙতে হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারকে গুনতে হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। অথচ মহাসড়ক আইন ২০২১-এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে মহাসড়কের ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না।
বিকল্প কী
স্থানীয় প্রশাসন এবং বাসিন্দারা বলছেন, সড়কের রুট একটু পাল্টে দিলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তারা বলছেন, নির্মাণ হতে যাওয়া সড়কটি শহরের পাস দিয়ে প্রেমতলা থেকে কানারবাজার অথবা কোটাপাড়া, রাজগঞ্জ হয়ে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা যেতে পারে।
ব্যবসায়ী বিল্লাল ব্যাপারী বলেন, ‘এখান দিয়ে মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে দুর্ঘটনা বাড়বে। শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করতে হবে। এতে করে শহর আর শহর থাকবে না। শহরের ভেতর দিয়ে না করে বাইপাস করে সড়কটি নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসানও শহরের ভেতর দিয়ে চার লেন সড়ক নির্মাণের বিরোধী। তিনি বলেন, ‘জেলা শহরের ওপর দিয়ে চার লেন সড়ক নেয়া হলে শহর নষ্ট হয়ে যাবে। জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে ৩ থেকে ৪ গুণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে।’
তিনি জানান, প্রেমতলা থেকে বাইপাস করে কীভাবে মনোহরবাজার শরীয়তপুর-চাঁদপুর হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে সড়ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। অবশ্যই শহর রক্ষা করে নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপাতত ২৭ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে। চার লেনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলেও আপাতত ৩৩ দশমিক ৫ ফুট প্রশস্ত করে দুই লেনের সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের প্রকল্পের মধ্যে মূল শহরের ২ কিলোমিটার অংশ পড়েছে। এই অংশে কোনো স্থাপনা ভাঙতে হবে না। পরবর্তী ৬ কিলোমিটার অংশে প্রচুর স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। ভবিষ্যতে ডিপিপি সংশোধন করে চার লেন করা হলে তখন কী হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’
শহরবাসী পক্ষে নয়
শরীয়তপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলী আকবর মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শরীয়তপুর খুবই ছোট একটি শহর। শহরের একটি মাত্র সড়কেই যাতায়াত করতে হয়। এখনই এই সড়কে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে তাতে আমরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। শহরের ভেতর দিয়ে মহাসড়ক গেলে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাবে।’
শহরের শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা সুমি আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা এই সড়ক দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে। মহাসড়কে উন্নীত করা হলে সব সময় ঝুঁকি নিয়ে চলতে হবে। দুর্ঘটনার শিকার হবে আমাদের সন্তানরা।’