রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ এফ আর টাওয়ার নামে একটি বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। বেশির ভাগের মৃত্যু হয় উঁচুতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ওই ভবনে ইমারজেন্সি সিঁড়ি থাকলেও প্রত্যেক ফ্লোর থেকে এই সিঁড়ি লক করা ছিল। তা না থাকলে মানুষগুলো বেঁচে যেতে পারত।
ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণ আইন ২০০৩-এ আছে, বহুতল ভবনে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ইমারজেন্সি সিঁড়ি রাখতে হবে। এই সিঁড়ি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে বের হওয়া যায়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশির ভাগ ভবনেই এই ইমারজেন্সি সিঁড়ি নেই।
আইন অনুযায়ী, ছয় তলার ওপরের ভবন বহুতল। তাই ছয় তলার বেশি উচ্চ ভবনের ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি ভিন্ন।
২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যালের গোডাউন থাকা ওয়াহেদ ম্যানসন আগুনে পুড়ে যায়। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
আইনে আছে, প্রত্যেক মাসে একবার বহির্গমন মহড়া করতে হবে। সাইরেন বাজিয়ে প্রত্যেক ভবনে থাকা লোকদের ইমারজেন্সি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার অভ্যাস করাতে হবে। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে আগুন নেভাতে ওই ভবনের ১৮ শতাংশ মানুষকে আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখাতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অনেকে ইমারজেন্সি সিঁড়িতে ধূমপান করেন। মালিকপক্ষ দেখে এই সিঁড়ি কোনো কাজে আসছে না। তখন মালিক এই সিঁড়ির গেট তালাবদ্ধ করে রাখেন।
এফআর টাওয়ারে একই ঘটনা ঘটেছে। ইমারজেন্সি সিঁড়ির গেট লক থাকার কারণে মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারেননি। অনেক ভবনের ইমারজেন্সি সিঁড়ি মানুষ চেনেনই না।
২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
দুই আইনে বহুতল ভবনের সংজ্ঞা দুই রকম
বহুতল ভবন করতে হলে ফায়ার সার্ভিস থেকে একটা ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (এনওসি) নিতে হয়। তবে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের বহুতলের ভবনের সংজ্ঞায় অমিল আছে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) আব্দুল হালিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস আইনে ছয় তলার ওপরের সকল ভবন বহুতল হলেও রাজউকের আইনে বহুতল গোনা হয় ১০ তলার ওপরের ভবনকে। এই কারণে আইনে অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায়।
‘একেক দেশে হাইরাইজ ও লোরাইজ বিল্ডিংয়ের সংজ্ঞা হয় ওই দেশের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতার ওপর। ১০ তলার ওপরে ভবন না করলে কেউ আমাদের কাছ থেকে এনওসি নেয় না। ফলে আগুন নেভাতে গিয়ে আমাদের অনেক সময় বেগ পেতে হয়।’
ভবনের সংজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছয় তলা হলে আমরা ছয় তলা থেকেই শুরু করব। ১০ তলা লাগবে না। সমস্যা কোথায়? ওনাদের (ফায়ার সার্ভিস) আইনে বলা আছে, আমাদের বিধিতে বলা আছে। আমাদের বিধিটা আগের। পরে ওনাদের আইনটা হয়েছে। আমরা দুই জায়গার আইন ও বিধি পরবর্তীতে সমন্বয় করে নেব। এটা আমাদের কোনো মনগড়া কথা না। একটা তাদের আইনে আছে, একটা আমাদের বিধিতে আছে।’
২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিস ঢাকা শহরের ভবনের ওপর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, রাজধানীতে ৫৪১টি শপিং মল বা বিপণিবিতান অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অবস্থিত।বাংলামোটরের আর কে টাওয়ারে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট। ছবি:সাইফুল ইসলাম
সংকীর্ণ গলি, দমকলের গাড়ি ঢোকে না
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) আব্দুল হালিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এমনও বহুতল ভবন আছে, যার গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘গলিতে গাড়ি ঢুকতে না পারার কারণে দূরে গাড়ি রেখে পাইপ দিয়ে আমরা পানির লাইন নিয়ে আগুন নেভাই। অনেক বহুতল ভবনে প্রয়োজনীয় ফায়ার সেফটিও নেই। পুরান ঢাকার কেমিক্যালের গোডাউন কিন্তু এখনো সরানো যায়নি। বঙ্গবাজারে আগুন লাগলে যা করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে করতে হবে। না হলে সব পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। পুরান ঢাকার বেশির ভাগ জায়গায় কোন বিল্ডিংয়ে কী আছে এটা বোঝা মুশকিল। অনেকে আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেক বহুতল ভবনে একটা মাত্র সিঁড়ি।’
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস একা পারবে না। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসার, কলকারখানা পরিদপ্তর, পরিবেশ দপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর সবাইকেই সমন্বয় করে ভালোভাবে দেখভাল করতে হবে।
সংকীর্ণ গলিতে কেন বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়, জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘কত প্রশস্ত রাস্তা হলে কত উঁচু ভবন করতে পারবে, সেটার নিয়ম আছে। সেই অনুযায়ী অনুমতি দেয়া হয়। যে অনিয়ম করে, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিই।’
সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতা
ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। এই কারণে দাম বেশি। দেশে উৎপাদন করা গেলে দাম কম হতো। তাহলে মানুষ ভবনে ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম ব্যবহারে উৎসাহিত হতো বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউস ও ফায়ার প্রিভেনশন) আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম যদি কম মূল্যে পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকেরা এগুলো সহজে বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। বাংলাদেশে যদি তৈরি হয়, তাহলে সবাই সহজে পাবে। বাংলাদেশে ফায়ার নির্বাপণ সরঞ্জামের কোনো কারখানা নেই।’
ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ঝুঁকি বাড়ায়
ফায়ার সার্ভিসের সমীক্ষায় ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়িই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিলাসিতা বেড়ে গেছে। এখন ভবনের ভেতরে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করা হচ্ছে। এর কারণে অগ্নিঝুঁকি বেড়ে গেছে। দাহ্য পদার্থ না পেলে আগুন সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে যথেষ্ট পরিমাণে হাইড্রো কার্বন বেড়ে যায়। আমাদের গৃহস্থালির জিনিসগুলো বেশির ভাগ প্লাস্টিক ও রাবার জাতীয়। এগুলো যথেষ্ট কার্বন ক্রিয়েট করে। এই কারণে এক বালতি পানি দিয়ে এই আগুন নেভানো যায় না। ফলে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে পৌঁছাতে আগুন দেখা যায় এক রুম থেকে অন্য রুমে চলে যায়। এই জন্য ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অনেকাংশে দায়ী।’
বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিস ঢাকা শহরের ভবনের ওপর সর্বশেষ জরিপ করে। এই জরিপে দেখা যায়, রাজধানীতে ৫৪১টি শপিং মল বা বিপণিবিতান অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অবস্থিত, যা এ ধরনের ভবনের ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ শপিং মল ৬৮৭টি, যা ৫৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ৯৪টি। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক ভবন ১৭৩টি। আর অতি ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন ১৭৩টি বা ৪৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।